বুধবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৭

মহাপুরুষ

মুহম্মদ কবীর সরকার
তুমি সেদিন আমার ঠোট ছুঁয়ে বলেছিলে
'তুমি এখনো পুরুষ হয়ে উঠুনি'
মহাপুরুষের মতো ওষ্ঠ হতে হবে কৃষ্ণ
নিগড় কৃষ্ণ'।
জানো, এখন আমার ঠোট তামাটে বর্ণের।
মহাপুরুষের মত এখন আমি নিকোটিনগ্রাহী।
যে ছেলেটি সিগারেট কি চিনতো না আজ সে মহাপুরুষ।
প্রতিটি চুমুকে গিলে খায় প্রেমিকার প্রেমের সাধ।

রবিবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৭

তুমি কেমন আছো?

কেমন আছো?______/মুহম্মদ কবীর সরকার
কেমন আছো? ইদানীং খুব বেশিই জানতে ইচ্ছে করে
মনে  পড়ে? সেই দিন গুলি, কাটাতাম খুব কিচ্ছে করে
কখনো কি দেখেছো?
কালের কালো অতীতেরা সব সম্পর্ক  নিচ্ছে কেড়ে
কেমন আছো? বড্ড বেশিই যে আজ জানতে ইচ্ছে করে
কখনো কি বুঝেছো?
সময়ের কঠিন টানাপোড়নের টানে হৃদয়ের বাঁধুনি যাচ্ছে ছিঁড়ে
যাচ্ছে ছিঁড়ে সময়ের গড়া গল্প গুলি
এসো, আজ একটু বসা যাক
একটু বসে চায়ের চুমুকে কুশলাদি অল্প বলি
কেমন আছো?
নীরব কেন? ভালো আছি বললেই তো পারো মিছে করে
আমি বলতে চাইনি থাকো, থাকো তুমি
পিছুটানের পিছে পড়ে।
আমি বলতে চাইনি রেখ, রেখ মনে সেই অতীত জীবন ভরে।
তবে, তবে মনে রেখো, তুমি সতত বিচরণ করো আমার প্রাণের পরে
সে তো অতীত নয়, সেতো বর্তমান
নিয়মিত শ্রাবণ হয়ে ঝরে পরে
তুমি কেমন আছো?

শুক্রবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৭

যাকে আজও খুজে বেড়াই

যাকে আজও খুজে বেড়াই
__________________
আমি এক কবিকে খুজতেছি বহুদিন ধরে। আমি যখন ফেসবুক প্রথম চালানো শিখি, তখন তার সাথে পরিচয়।তিনি দারুণ লিখতেন। তার প্রতিটি লেখায় আমার ভালো লাগতো। তার সাথে চ্যাট করে আমার টুকটাক ভাব হয়েছিল।তার জীবনের গল্প যখন আমায় লিখতো অনেক আগ্রহ নিয়ে পড়তাম। সেই থেকে তার আমি ফ্রেন্ড। অথচ এই রকম মানুষের সাথে বন্ধু হওয়া যায়না কারণ তিনি ছিলেন বড় মাপের কবি আর আমি কিছুই না! হঠাৎ করে আর সে আসিনি। ফেসবুক শব্দটা হয়তো সে ভুলেই গেছে কিন্তু আমি তাকে আজও ভুলিনি। আমি তাকে সত্যিই অনেক ভাল ভালোবাসি।তাকে নিয়ে আমি অনেক কবিতা, গল্প লিখেছি ।
সে আমার প্রিয় কবি সুদীপ তন্তুবায় নীল
সুদীপ দাদা কখনো যদি ফেবুকে আসো হয়তো আমার মেসেজ পড়ে বিরক্ত হয়ে যাবে। যেখানে আছো ভালো থেকো দাদা। এসো কোনো এক শেষ বিকেলে, শেষ বিকেলের কবি হয়ে।

আমি ভালোবাসি জীবনানন্দ

আমি ভালোবাসি জীবনানন্দ
-মুহম্মদ কবীর সরকার
আমি ভালোবাসি রূপসী বাংলার খুলা কেশের গন্ধ
আমি ভালোবাসি তোমায় হে কবি জীবনানন্দ।
আমি ভালোবাসি সবুজ বাংলার কোমল ঘাস
আমি ভালোবাসি চির চঞ্চলমতি প্রবাহিণী তিতাস।
আমি ভালোবাসি তোমায় নাটোরের বনলতা
আমি ভালোবাসি আমার বাংলার কবিতার কথা।
দেখতে ভালোবাসি তিতাসের বুনোহাঁস বেলা অবেলা
আকাশ পানে তাকিয়ে দেখি শঙ্খচিলের খেলা।
লক্ষ্মীপেঁচা যবে ঝরা পালক ঝেরে কন্ঠে মেলায় তান
আমি ভালোবাসি শুনতে রূপসী বাংলার গান।
বঙ্গের বক্ষ পানে পাখির কলতানে
খুঁজে পাই আমি বঙ্গের নীল গগনে
খুঁজে পাই এক যৌবনা ধানের গন্ধ,
তাই তো তোমায় ভালোবাসি হে কবি জীবনানন্দ।

শেষ চিঠি

শেষ চিঠি
মুহম্মদ কবীর সরকার
_______________
কিছু কলমের কালি। একটা তুচ্ছ কাগজ। একের পর এক মনের মাধুর্য মিশিয়ে সাজানো কিছু হিজিবিজি শব্দ।আজ ও আমায় ভাবায়। শব্দের কি নিষ্ঠুর নীরবতা, কি আকুলতা! যেন একটি মানুষের ভালোবাসা, দুঃখ, বেদনা চুপটি করে বসে আছে চিঠি নামক ক্ষুদ্র কাগজে। নিভৃতচারী হয়ে ভ্রমণ করছে আমার হৃদয়ে।
আমি তখন কিশোরী। আমার এই ছোট্ট মনে দোলা দেয় এমনি একটি তুচ্ছ কাগজ। অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ছিলাম। বাবা ছিলেন সরকারি অফিসার। সেই সুবাদে আমরা চট্টগ্রাম থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বদলী হয়ে ছিলাম। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মফস্বল শহরে সেই রকম জানা শুনা আমার কেউ ছিল না। অন্নদা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে কারো সাথে সেই রকম ভাব জমছিল না। অচেনা শহর, অচেনা স্কুল, অচেনা পৃথিবী। তখন প্রায় একা হয়েই পড়েছিলাম। তবে পত্র-পত্রিকায় লেখালিখি করে ও বই পড়ে টুকটাক সময় যাচ্ছিলো। হ্যা তখন ও ফেবু, ইমু সবই ছিল। আমার ওই সবে সেই রকম আগ্রহ ছিল না বললেই চলে। সারাক্ষণ বই পড়ে সময় কাটাতেই ভালো লাগতো।
একদিন একটা মাসিক ম্যাগাজিনের পত্র মিতালী পাতায় একটুকরো অনুচ্ছেদ বন্ধুর খুঁজে লিখেছিলাম। সেই রকম ভাবে সাড়া পাইনি কারণ তখন সবাই চিঠিপত্তের সেকেলে নিয়ম বর্জন করে মেসেঞ্জার, ইমু,হোয়াটস্প নিয়েই ব্যস্ত ছিল। তবে কিছু সাহিত্য প্রেমি ছিল যারা এখনো চিঠি ভালোবাসে। সেই রকম কিছু বন্ধু আমায় অবাক করে চিঠি লিখেছিল। তার মধ্যে চিঠি লিখেছিলেন সেকেলের পত্রপত্রিকার চির পরিচিত মুখ সুদীপ্ত মেহেরাজ।
তখন আমার একাকীত্বে যেন মধুর স্বাদ পেয়েছিলাম। সুদীপ্ত মেহেরাজ চিঠিতে লিখেছেন।
প্রিয় মিমুণি,
তোর লেখা আমি সব সময় খুব মন দিয়ে পড়ি। তোর শিশুতোষ গল্প, কবিতা বরাবরি আমায় শিশু ভাবটা জাগিয়ে তোলে আমায় করে তোলে শিশু। তোর শিশু মনস্ক লিখা আমায় ভাবায়,হাসায়, কাদায়। আমার ভাবনায় চলে আসে যেন শিশু মীমটি আমার পাশে এসে ঘুরাঘুরি করছে।আমি নিয়মিত তোকে তোর লেখায় আবিষ্কার করতাম,তুই বলতি দাদা আমায় একটা কবিতা শুনাও না,বলতি চলো না দাদা ঘুড়ি উড়াই, ফড়িং ধরি।তখন আমি ঘুড়ি নিয়ে যেন মাঠে চলে যেতাম,আকাশে উড়িয়ে দেয় ঘুড়ি আর তুই হাত তালি দিতিস। আরো কত রকম বায়না। দিদি তুই কেমন আছিস? আমি অনেক দিন ধরে ভেবেছিলাম পত্রিকায় তোর ঠিকানাটা চাইবো কিন্তু চাও হয় নি। কাল যখন পত্র মিতালীতে তোর ঠিকানা পেলাম আর নিজে ধরে রাখতে পারলাম না। তাই তোকে ভেবে লিখতে বসলাম।
বন্ধু কি জানিস?
মনের কথা অকপটে বলা।
বন্ধু কি জানিস?
সুখে দুঃখে একই সাথে চলা।
বন্ধু কি জানিস?
ঝগড়া অভিমান আর রাগারাগি।
বন্ধু কি জানিস?
হৃদয়ের সবটুকু প্রেম ভাগাভাগি।
তুই কি সত্যিই বন্ধু হবি আমার।
ইতি
তোর চিঠির অপেক্ষারত
সুদীপ দা।
সেদিন চিঠি হাতে পেয়ে অনেক খুশি হয়েছিলাম। কতবার যে চিঠিটা পড়েছিলাম তা ঠিক ঠাহর করতে পারছি না। তারপর চিঠি লিখতে বসে ছিলাম। কি লিখবো কিছুই মাথায় আসছি না। লিখলাম..
প্রিয় সুদীপ দা
তুমি চিঠি দিবে আমি কখনো ভাবিনি। আমি তোমার নিয়মিত পাঠিকা।তোমার রোমান্টিক গল্প ও কবিতা গুলি আমার অনেক ভালো লাগে। তোমার বিরহের গল্প গুলি আমায় কাদায়। তোমার লেখায় এতো বিরহ কেন দাদা? আমাকে এতো কাদায় কেন? সে দিন তোমার 'শেষ কথা 'গল্পটি পড়ে প্রচুর কেঁদেছিলাম।গল্পের শেষ কথাটা কি হতে পারে জানো আজো ভেবে পাইনা। যেন গল্পটা আমার সাথে ঘটে গেছে। আমি গল্পে একটা বাস্তবিক গন্ধ পেয়েছিলাম। আমি জানতাম গল্পেরা মিথ্যা হয়, কিন্তু তোমার গল্প আমার কাছে সত্য মনে হল কেন দাদা? তুমি কেমন আছো দাদা? আমি তোমার এই ভাবে সব সময় বন্ধু হয়ে থাকতে চাই। শুনতে চাই তোমার সুখ দুঃখের গল্প।
ইতি
তোমার ছোট্টদি মীম।

এই ভাবে আমাদের বন্ধুত্বের তথা ভাইবোনের গল্পটা শুরু হয়েছিল। অতঃপর অধীর আগ্রহে সুদীপদার পরবর্তী চিঠির অপেক্ষা করতে লাগলাম।
চলমান....

মঙ্গলবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৭

ভোরের কুয়াশা

ভোরের কুয়াশা
-মুহম্মদ কবীর সরকার
একদিন আমি হেটেছিলাম এই বাংলায়
নগ্ন পায়ে ভোরের ভেজা কুয়াশায়।
আর শুনেছিলাম পাখিদের কলহ, কলরব
যেন তারা, তাড়া করে চলেছে এই মহাকালকে।
যখন এক ঝাপটা হাওয়া পরেছিল আমার প্রাণের পরে,
চুল এলোমেলো করে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে ছিলাম।
সাধ নিয়ে ছিলাম তার দেহের, তার নরম শরীরের গন্ধের।
সে কি গন্ধ, নাকি নতুন করে বাঁচার সাধ পাওয়া।
হঠাৎ চঞ্চল, উচ্ছল ষোড়শীর ওঙ্কারে,
লাল টিপ ও সবুজ শাড়ির আলোয়
ছেদ পড়ে সম্মোহনের।
তার সবুজ কোমল দেহ যেন কথা কয় প্রতিটি ইতিহাসের!
কথা কয় গত হওয়া শত মহাকালের।
মহাকাল পেরিয়ে তার জন্ম এই এশিয়ার পলিমাটিরর দেশে
শত বছর পরেও যেন আজ সে সেই কিশোরীর বেশে।
কিশোরীর বেশে সেই জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন।

খিচুড়ির লিমেরিক

খিচুড়ির লিমেরিক
মুহম্মদ কবীর সরকার
অনাহারী ঘরে ঘরে
পুটলি খালি কি মুড়ির!
বৃষ্টির জলে দেশ যে তলে
বলতো আছে কি চুরির?
ভিটামাটি জলের তলে
নেতা পালাই নানন ছলে
উঁচুটিলায় বসে দাদা
প্রেমে পড়েন খিচুড়ির!

সোমবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৭

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিখ্যাত ব্যক্তিদের উক্তি

শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে,আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে
ফিদেল কাস্ত্রো

আমি হিমালয় দেখিনি কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব এবং সাহসিকতায় তিনিই হিমালয়।
ফিদেল কাস্ত্রো


আপোষহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুম কোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ঠ্য
ইয়াসির আরাফাত

শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রণী বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।।
গৌরী প্রসন্ন মজুমদার


কোনো জেল জুলুমই কোনোদিন আমাকে টলাতে পারেনি, কিন্তু মানুষের ভালবাসা আমাকে বিব্রত করে তুলেছে
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

৭৫ এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ২১ বছর নিষিদ্ধ ছিল ৭ই মার্চের ভাষণ। রেডিও-টিভিতে এই ভাষণ প্রচার করা হতো না কখনো। অনেকেই মাইকে এই ভাষণ প্রচার করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছেন, প্রাণ দিয়েছেন। আজ সেই ঐতিহাসিক ভাষণ ১২ টি ভাষায় অনুদিত হয়েছে, ২৫০০ বছরের শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি ভাষণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

শেখ মুজিব নিহত হবার খবরে আমি মর্মাহত। তিনি একজন মহান নেতা ছিলেন।তার অনন্যসাধারন সাহসিকতা এশিয়া ও আফ্রিকার জনগনের জন্য প্রেরণাদায়ক ছিল।
ইন্দিরা গান্ধী
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন সমাজতন্ত্র প্রতীষ্ঠার সংগ্রামের প্রথম শহীদ। তাই তিনি অমর।
সাদ্দাম হোসেন

শেখ মুজিবুর রহমান ভিয়েতনামী জনগনকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন
কেনেথা কাউণ্ডা

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডে বাঙলাদেশই শুধু এতিম হয় নি বিশ্ববাসী হারিয়েছে একজন মহান সন্তানকে
জেমসলামন্d

শেখ মুজিবকে চতুর্দশ লুই য়ের সাথে তুলনা করা যায়। জনগন তার কাছে এত প্রিয় ছিল যে লুই ইয়ের মত তিনি এ দাবী করতে পারেন আমি ই রাষ্ট্র।
সংগৃহীত
আওয়ামিলীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মত তেজী এবং গতিশীল নেতা আগামী বিশ বুছরের মধ্যে এশিয়া মহাদেশে আর পাওয়া যাবে না
হেনরি কিসিঞ্জার

মুজিব হত্যার পর বাঙালীদের আর বিশ্বাস করা যায় না, যারা মুজিবকে হত্যা করেছে তারা যেকোন জঘন্য কাজ করতে পারে
উইলিবান্ট

বঙ্গবন্ধুর বিখ্যাত উক্তি

আজকে অন্যতম মহান বাঙ্গালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু বার্ষিকী। এই দিনে তিনি স্বপরিবারে নিহত হন। তার মৃত্যু বার্ষিকীতে গভীর শোক জানাচ্ছি।
এবার দেখে আসি মহান এই বাঙ্গালীকে নিয়ে বিশ্বের বিখ্যাত কিছু মানুষের বিখ্যাত উক্তি গুলো দেখে আসি :
১. আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।
২. এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম!
৩. মানুষকে ভালোবাসলে মানুষও ভালোবাসে। যদি সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেন, তবে জনসাধারণ আপনার জন্য জীবন দিতেও পারে।
৪. আমার সবচেয়ে বড় শক্তি আমার দেশের মানুষকে ভালবাসি, সবচেয়ে বড় দূর্বলতা আমি তাদেরকে খুব বেশী ভালবাসি।
৫. প্রধানমন্ত্রী হবার কোন ইচ্ছা আমার নেই। প্রধানমন্ত্রী আসে এবং যায়। কিন্তু, যে ভালোবাসা ও সম্মান দেশবাসী আমাকে দিয়েছেন, তা আমি সারাজীবন মনে রাখবো।
৬. সাত কোটি বাঙ্গালির ভালোবাসার কাঙ্গাল আমি। আমি সব হারাতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা হারাতে পারব না।
৭. বিশ্ব দুই শিবিরে বিভক্ত - শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।
৮. এই স্বাধীন দেশে মানুষ যখন পেট ভরে খেতে পাবে, পাবে মর্যাদাপূর্ণ জীবন; তখনই শুধু এই লাখো শহীদের আত্মা তৃপ্তি পাবে।
০৯. দেশ থেকে সর্বপ্রকার অন্যায়, অবিচার ও শোষণ উচ্ছেদ করার জন্য দরকার হলে আমি আমার জীবন উৎসর্গ করব।
১০. আমি যদি বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে না পারি, আমি যদি দেখি বাংলার
মানুষ দুঃখী, আর যদি দেখি বাংলার মানুষ পেট ভরে খায় নাই, তাহলে আমি শান্তিতে মরতে পারব না।
১১. এ স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না খায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এদেশের মানুষ যারা আমার যুবক শ্রেণী আছে তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়।
১২. আমাদের চাষীরা হল সবচেয়ে দুঃখী ও নির্যাতিত শ্রেণী এবং তাদের অবস্থার উন্নতির জন্যে আমাদের উদ্যোগের বিরাট অংশ অবশ্যই তাদের পেছনে নিয়োজিত করতে হবে।
১৩. যিনি যেখানে রয়েছেন, তিনি সেখানে আপন কর্তব্য পালন করলে দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে না।
১৪. সরকারী কর্মচারীদের জনগণের সাথে মিশে যেতে হবে। তারা জনগণের খাদেম, সেবক, ভাই। তারা জনগণের বাপ, জনগণের ছেলে, জনগণের সন্তান। তাদের এই মনোভাব নিয়ে কাজ
করতে হবে।
১৫. সমস্ত সরকারী কর্মচারীকেই আমি অনুরোধ করি, যাদের অর্থে আমাদের সংসার চলে তাদের সেবা করুন।
১৬. গরীবের উপর অত্যাচার করলে আল্লাহর কাছে তার জবাব দিতে হবে।
১৭. জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। এই কথা মনে রাখতে হবে। আমি বা আপনারা সবাই মৃত্যুর পর সামান্য কয়েক গজ কাপড় ছাড়া সাথে আর কিছুই নিয়ে যাব না। তবে কেন আপনারা মানুষকে শোষণ করবেন, মানুষের উপর অত্যাচার করবেন?
১৮. দেশের সাধারণ মানুষ, যারা আজও দুঃখী, যারা আজও নিরন্তর সংগ্রাম করে বেঁচে আছে, তাদের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখকে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির উপজীব্য করার জন্য শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীদের প্রতি আহবান জানাচ্ছি।
১৯. সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন। তাই মাটি ও মানুষকে কেন্দ্র করে গণমানুষের সুখ, শান্তি ও স্বপ্ন এবং আশা-আকাঙ্খাকে অবলম্বন করে গড়ে উঠবে বাংলার নিজস্ব সাহিত্য-সংস্কৃতি।
২০. বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ না থাকলে আমাদের স্বাধীনতার অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।
২১. গণআন্দোলন ছাড়া, গণবিপ্লব ছাড়া বিপ্লব হয় না।
২২. জনগণকে ছাড়া, জনগণকে সংঘবদ্ধ না করে, জনগণকে আন্দোলনমুখী না করে এবং পরিস্কার আদর্শ সামনে না রেখে কোন রকম গণআন্দোলন হতে পারে না।
২৩. আন্দোলন মুখ দিয়ে বললেই করা যায় না। আন্দোলনের জন্য জনমত সৃষ্টি করতে হয়। আন্দোলনের জন্য আদর্শ থাকতে হয়। আন্দোলনের জন্য নিঃস্বার্থ কর্মী হতে হয়। ত্যাগী মানুষ থাকা দরকার। আর সর্বোপরি জনগণের সংঘবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ সমর্থন থাকা দরকার।
২৪. অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোন দিন একসাথে হয়ে দেশের কাজে নামতে নেই। তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়।
২৫. রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের চারটি জিনিসের প্রয়োজন, তা হচ্ছে: নেতৃত্ব, ম্যানিফেস্টো বা আদর্শ, নিঃস্বার্থ কর্মী এবং সংগঠন।
২৬. ভিক্ষুক জাতির ইজ্জত থাকে না। বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে এনে দেশকে গড়া যাবে না। দেশের মধ্যেই পয়সা করতে হবে।
২৭. বাংলার উর্বর মাটিতে যেমন সোনা ফলে, ঠিক তেমনি পরগাছাও জন্মায়! একইভাবে,
বাংলাদেশে কতকগুলো রাজনৈতিক পরগাছা রয়েছে, যারা বাংলার মানুষের বর্তমান দুঃখ-দূর্দশার জন্য দায়ী।
২৮. যদি আমরা বিভক্ত হয়ে যাই এবং স্বার্থের দ্বন্দ ও মতাদর্শের অনৈক্যের দ্বারা প্রভাবান্বিত
হয়ে আত্বঘাতী সংঘাতে মেতে উঠি, তাহলে যারা এদেশের মানুষের ভালো চান না ও এখানাকার সম্পদের ওপর ভাগ বসাতে চান তাদেরই সুবিধা হবে এবং বাংলাদেশের
নির্যাতিত, নিপীড়িত, ভাগ্যাহত ও দুঃখী মানুষের মুক্তির দিনটি পিছিয়ে যাবে।
২৯. আর সাম্প্রদায়িকতা যেন মাথাচারা দিয়ে উঠতে না পারে। ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ। মুসলমান তার ধর্মকর্ম করবে। হিন্দু তার ধর্মকর্ম করবে। বৌদ্ধ তার ধর্মকর্ম করবে। কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না।
৩০. পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না।
৩১. ভুলে যেয়ো না। স্বাধীনতা পেয়েছো এক রকম শত্রুর সাথে লড়াই করে। তখন আমরা জানতাম আমাদের এক নম্বর শত্রু পাকিস্থানের সামরিক বাহিনী ও শোষকগোষ্ঠী। কিন্তু, এখন
শত্রুকে চেনাই কষ্টকর।
৩২. শহীদদের রক্ত যেন বৃথা না যায়।
৩৩. বাংলাদেশ এসেছে বাংলাদেশ থাকবে।
৩৪. বাংলার মাটি দু্র্জয় ঘাঁটি জেনে নিক দুর্বৃত্তেরা।
৩৫. বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধীর বিচার হবেই।
এবার তাকে নিয়ে বিখ্যাত ব্যক্তিদের কিছু উক্তি :
১. মুজিব হত্যার পর বাঙালীদের আর বিশ্বাস করা যায় না,যারা মুজিবকে হত্যা করেছে তারা যেকোন জঘন্য কাজ করতে পারে
---নোবেল বিজয়ী উইলিবান্ট।
২. শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে,আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে
—ফিদেল কাস্ট্রো।
৩. আপোষহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুম কোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ঠ্য
—ইয়াসির আরাফাত।
৪. শেখ মুজিব নিহত হবার খবরে আমি মর্মাহত। তিনি একজন মহান নেতা ছিলেন।তার অনন্যসাধারন সাহসিকতা এশিয়া ও আফ্রিকার জনগনের জন্য প্রেরণাদায়ক ছিল।
–ইন্দিরা গান্ধী।
৫. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন সমাজতন্ত্র প্রতীষ্ঠার সংগ্রামের প্রথম শহীদ।তাই তিনি অমর।
–সাদ্দাম হোসেন।
৬. শেখ মুজিবুর রহমান ভিয়েতনামী জনগনকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন
— কেনেথা কাউণ্ডা।
৭. "শেখ মুজিব দৈহিকভাবেই মহাকায় ছিলেন, সাধারণ বাঙালির থেকে অনেক উচুঁতে ছিলো তার মাথাটি, সহজেই চোখে পড়তো তার উচ্চতা। একাত্তরে বাংলাদেশকে তিনিই
আলোড়িত-বিস্ফোরিত করে চলেছিলেন, আর তার পাশে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে যাচ্ছিল তার সমকালীন এবং প্রাক্তন সকল বঙ্গীয় রাজনীতিবিদ।
জনগণকে ভুল পথেও নিয়ে যাওয়া যায়; হিটলার মুসোলিনির মতো একনায়কেরাও জনগণকে দাবানলে, প্লাবনে, অগ্নিগিরিতে পরিণত করেছিলো, যার পরিণতি হয়েছিলো ভয়াবহ। তারা জনগণকে উন্মাদ আর মগজহীন প্রাণীতে পরিণত করেছিলো। একাত্তরের মার্চে শেখ মুজিব
সৃষ্টি করেছিলো শুভ দাবানল, শুভ প্লাবন, শুভ আগ্নেয়গিরি, নতুনভাবে সৃষ্টি করেছিলেন বাঙালি মুসলমানকে, যার ফলে আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম।"
--হুমায়ুন আজাদ
৮. বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডে বাঙলাদেশই শুধু এতিম হয় নি বিশ্ববাসী হারিয়েছে একজন মহান সন্তানকে।
– জেমসলামন্ড,ইংলিশ এম পি।
৯.শেখ মুজিবকে চতুর্দশ লুই য়ের সাথে তুলনা করা যায়। জনগন তার কাছে এত প্রিয় ছিল যে লুই ইয়ের মত তিনি এ দাবী করতে পারেন আমি ই রাষ্ট্র।
--- পশ্চিম জার্মানী পত্রিকা।
১০.আওয়ামিলীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মত তেজী এবং গতিশীল নেতা আগামী বিশ বুছরের মধ্যে এশিয়া মহাদেশে আর পাওয়া যাবে না
---- হেনরি কিসিঞ্জার।
১১.শেখ মুজিব নিহত হলেন তার নিজেরই সেনাবাহিনীর হাতে অথচ তাকে হত্যা করতে পাকিস্তানীরা সংকোচবোধ করেছে।
বিবিসি-১৫ আগস্ট ১৯৭৫।
মন্ ৪ টি র +১/-০
মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন
১| Im ১৫ ই আগস্ট, ২০১৪ বিকাল ৪:০৫
রাকিব জাভেদ মিন্টু বলেছেন: ভাই তানজিল মোহাম্মাদীন, একটি বাদ পড়ে গেছে,
সাতকোটি মানুষের সাড়ে সাত কোটি কম্বল, আমার কম্বল কয়?
২| Im ১৫ ই আগস্ট, ২০১৪ বিকাল ৪:৩১
ইলি বিডি বলেছেন: শেখ মুজিব নিহত হলেন তার নিজেরই সেনাবাহিনীর হাতে অথচ
তাকে হত্যা করতে পাকিস্তানীরা সংকোচবোধ করেছে।
বিবিসি-১৫ আগস্ট ১৯৭৫।
৩| Im ১৫ ই আগস্ট, ২০১৪ বিকাল ৪:৪০
মুদ্দাকির বলেছেন: " প্রধানমন্ত্রী হবার কোন ইচ্ছা আমার নেই। প্রধানমন্ত্রী আসে এবং যায়। কিন্তু, যে ভালোবাসা ও সম্মান দেশবাসী আমাকে দিয়েছেন, তা আমি সারাজীবন মনে রাখবো। "
তার স্বাধীনতা পরবর্তি কর্ম কান্ডে বুঝাযায় যে তার এই উক্তিটি মিথ্যা ছিল!!!
দুঃখ জনক কিন্তু সত্য

আম কুড়ানো

আম কুড়ানো
মুহম্মদ কবীর সরকার
আম কুড়ানো জাম কুড়ানো
করছে সদা হুল্লোরে
বৃষ্টি-বাদল নেই কিরে তোর?
তারপরও সে চললো রে।
সাঝ-সকালে যায় না ওরে
পেছন ফিরে আয় না ওরে,
গুড়ুম গুড়ুম ডাকছে আকাশ
বিজলী এইতো জ্বললো রে!
কসবা,ব্রাহ্মণবাড়িয়া

Firefly

Firefly
Muhammad Kabir sarkar
It's night,mid night
of my heart,
It's fire, blue fire
of my blood.
Fire fly, Firefly
in the sky,
It's touch,only catch
Stars cry.
It's love, reside hope
my beloved.
It's fire, blur fire
of my blood......
©kabir

দুই স্বাধীন দেশের মাঝখানে চাপা পড়া পরাধীনতার গল্প

দুই স্বাধীন দেশের মাঝ খানে চাপা পড়া পরাধীনতার গল্প...
সংগ্রহ :আনন্দবাজার পত্রিকা
__________________________
হে স্বাধীনতা, আমাদের পাট্টা দাও
এ পার স্বাধীন, ও পার স্বাধীন, মধ্যিখানে চর!
সেই চরাচরেও স্বাধীনতা দিবস আসে। খুদেরা ইস্কুলে যায়। শিক্ষকেরা স্বাধীনতা দিবস সম্পর্কে দু'চার কথা বলেন। সমস্বরে আওয়াজ ওঠে-বন্দে মাতরম্। তার পরে লজেন্স চুষতে চুষতে বাডি ফেরা।
-'হ্যাঁ রে, এত সক্কাল সক্কাল বাডি চইলি এইলি যে!'
-'আজ তো ১৫ অগস্ট গো! স্বাধীনতা দিবস!'
গোলার গায়ে গোবর লেপতে লেপতে ঝাঁঝিয়ে ওঠেন মাঝবয়সী মহিলা, 'অ! তাইলি তো মাস্টারদের ভারী মজা। তোদেরও। তা এক কাজ কর দিকি। একছুটে আব্বাকে চাট্টি খাবার দিয়ে আয়।'
-'আম্মা, আমাদের বাডিতে পতাকা নাই ক্যান?'
-'তুর আব্বাকে জিগাস।
আমি কী কইরি বুইলব?'
ইস্কুল থেকে পাওয়া কাগজের একটা তেরঙ্গা হাতে খুদে ছোটে খেতের দিকে।
চারপাশে বুনো ঘাস, বাতাসে বর্ষার সোঁদা গন্ধ। বুকের ভিতরে হাপরের ওঠানামা। মাথার ভিতরে স্কুলের শিক্ষকদের ভাষণ- 'পরাধীনতার যন্ত্রণা, সুভাষ বোস, ক্ষুদিরাম, গাঁধীজি...।'
রাত পোহালেই ১৫ অগস্ট। পাডার মোেড, ক্লাবে, মাচায় সাউন্ড বক্সে গাঁক গাঁক করে বাজছে- 'জয় হো', 'অ্যায মেরে ওযাতন কি লোগো' কিংবা 'মুক্তির মন্দির সোপান তলে'...। ছেলেপুলেদের উত্সাহের অন্ত নেই।
-'সন্ধ্যে সাতটার মধ্যে চলে আসবি কিন্তু।'
-তার আগেই সব প্রোগ্রাম শেষ হয়ে যাবে তো?
-আলবাত! মেজদাকে এ বার একটু কম বকবক করতে বলবি।
-'আর তোদের কী খবর রে, সব এনেছিস তো?'
-'সকলেই কি তোর মতো? সব আগের রাতে তোলা আছে!'
-'মাংস, সোডা, বরফ?'
-'হ্যাঁ রে বাবা, সব থাকবে। তুই শুধু সকাল সকাল চলে আসিস। আগের বারের মতো ডোবাস না!'
-আর এটা কী করেছিস? ডিপিটা বদলাবি না? আমার ডিপিতে তো তেরঙ্গা।
-ভাল বলেছিস ভাই, দাঁডা আমারটাতেও করে নিই।
আবার একটা ১৫ অগস্ট। আবার একটা পেড পাওয়া ছুটি। এমনিতেই এ বার স্বাধীনতা দিবস মঙ্গলবার। শনি, রবি ছুটি। সোমবারটা 'ম্যানেজ' করতে পারলেই কাছেপিঠে পুরী, দিঘা কিংবা মন্দারমণি। দার্জিলিং বাদ। কেননা সেখানে হাওয়া গরম। যদি কোথাও না যাওয়া হয় তা হলে কোনও আত্মীয়ের বাডি। না হলে সপরিবার গুছিয়ে এ দিক ও দিক ঘুরে, পপকর্ন খেতে খেতে জমিয়ে সিনেমা দেখে, ডিনারটা কোনও রেস্তোরাঁয় সেরে বাডি ফেরা।
ঘোলা পদ্মার উপরে সামিয়ানার মতো ঝুলছে কুচকুচে কালো মেঘ। মাঝেমধ্যেই বৃষ্টি নামছে। ক্লান্তি ভুলে ভিজতে ভিজতে অবিরাম পারাপার করছে হিসেবি নৌকো। পেটের মধ্যে চাল, ডাল, আনাজ, জ্বালানি। উপরে তার্পোলিন দেওয়া। জিনিসপত্তর যাতে ভিজে না যায়। হাট শেষে এ পার থেকে নৌকা ও পারে পৌঁছলে তবেই উনুন জ্বলবে। হাঁডি চডবে। ভাতের গন্ধে ম ম করবে চরাচর।
কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পেডছে কোলের ছেলে। বডটা ঘ্যানঘ্যান করছে, ''ও আম্মি, ভাত কোখুন হবে?'' বাডির কর্তা গামছা নিয়ে স্নানের তোডজোড করছেন, ''আর কদ্দুর গো?'' গরম ভাত বাডতে বাডতে কর্ত্রী হাসছেন, ''হোয়ি গিয়েচে। শিগ্গির আসো।''
নিকোনো উঠোন আছে, পেটে খিদে আছে, বুকে ভালবাসা আছে, অন্তরাত্মায় ভয় আছে, সাহস করে পালিয়ে বিয়ে করা আছে, দায়িত্ব নিয়ে বাচ্চাকাচ্চা মানুষ করা আছে, মেনে চলা শাসন আছে, আবশ্যিক অনুশাসন আছে, ভারী বুটের আওয়াজ আছে, ভাষা বুঝতে না পারার শাস্তি, বেমক্কা চড-থাপ্পড আছে। কিন্তু স্বাধীন দেশে থেকেও স্বাধীনতা নেই!
বিক্ষিপ্ত অশান্তি, 'উধাও' কমিশন
নিজের গ্রাম থেকে যখন তখন বেরোনো যাবে না। ইচ্ছেমতো পদ্মা পার হওয়া যাবে না। ভোটার কার্ড ভুলে যাওয়া যাবে না। এবং আরও অনেক না। পদ্মা পেরিয়ে চরের গ্রামে যেতে প্যান কার্ড নয়, আধার কার্ড নয়, ড্রাইভিং লাইসেন্সও নয়- দরকার ভোটার কার্ড।
যে কার্ড দেখে মুর্শিদাবাদের উদয়নগর খণ্ড, চরপরাশপুর, কাকমারির বরকত আলি, হাসান শেখেরা মাচায় বসে হাসতে হাসতে গডিয়ে পেডন, ''ও কত্তা, এ কার্ড আপনি কুতায় থোন? আলমারির ভেতরে নাকি? এ তো এক্কেবারে লতুন গো!''
ভোটার কার্ড চকচকে হলে যে বিডম্বনায় পডতে হয়, কে জানত!
বরকত বলে চলেন, ''সে তো বাবু, আপনাদের কার্ড লতুন হবেই। আপনাদের তো আর কতায় কতায় কার্ড দেখাতে হয় না! কার্ড তো বের করেন খুব দরকারি কাজে। আর সেই ভোটের সময়। আর আমরা?''
পাশ থেকে খেই ধরেন বরকতের থেকে বয়সে একটু বড হাসমত শেখ, ''আমাদের তো বাবু কার্ডই সব। রাইতির বেলায় এ কার্ড আমরা বালিশের তলায় রেইকিই ঘুমাই। সক্কালে উইটিই তো ওইডাই সব্বার আগে দরকার।''
ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট করে দিলেন তিনিই, ''বুইলেন না তো? মানে ধরুন, এই যে কার্ড (লুঙ্গির কষি থেকে বের করে) দ্যাখতাসেন, এই কার্ড আছে মানে ছবিডা আছে, ছবিডা আছে মানে আমি আছি। আর আমি আছি মানে আমার পোলা-বউ-পরিবার সক্কলে আছি। কার্ড নাই মানে আমিও নাই। আমি নাই, মানে কিস্যু নাই।'' বরকত বলে চলেছেন, ''আর সেই কাণেই তো আমাদের কার্ডটা বড তেলচিটে। নোংরা। তা বাবু আমাদের স্বাধীনতার কতা আপনাদের শহরের গিয়ি বুইলবেন তো?''
আটপৌরে সেই মাচা থেকে ইস্কুল দেখা যায় না। কিন্তু লম্বা বাঁশের ডগায় বাঁধা তেরঙ্গা উডছে। সাদা অংশের মধ্যিখানে চাকাটাও যেন বনবন করে ঘুরছে। কিন্তু সত্যি সত্যিই কি ঘুরছে?
মাচার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ক্যাঁচ করে ব্রেক কষে দাঁডাল বিএসএফের জিপসি।
-'কী ব্যাপার?'
-'আজ্ঞে, খবরের কাগজ থেকে এসেছি।'
-'বেশ। কিন্তু কোনও ছবি তুলবেন না। কাজ হয়ে গেলে এক বার ক্যাম্পে আসুন।'
বরকত ফিসফিস করেন, ''কী বাবু, কী বুইলেন? ওরাই এখানকার হত্তা-কত্তা-বিধাতা। ওদের মর্জিতেই সীমান্তে সুয্যি ওঠে, অস্ত যায়। পাখি ওেড। আমরাই খালি না ঘরকা, না ঘাটকা হয়ে থেকে গেলাম। আচ্ছা বাবু, আমরা কেন স্বাধীন হলাম না?''
স্বাধীনতার এত বছর পরেও এই প্রশ্নটা শুনতে হয়। শুনতে হচ্ছে। চরের পলিতে হলদেটে বাঁশের আগায় পতপত করে ওেড তেরঙ্গা, তাকে ঘিরে চরের বাসিন্দারা মাথা নিচু করে প্রার্থনা করেন- 'হে স্বাধীনতা, আমাদের পাট্টা দাও'।
বছর কয়েক আগের কথা। কলকাতার নন্দন চত্বর।
কাঁপাকাঁপা গলায় এক মহিলা ককিয়ে উঠলেন-"আমার ছেলের খুনের বিচার চাই। আপনারা বিচার দেবেন না?"
পুত্রহারা মায়ের এমন আর্তি শুনে যেন থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল ব্যস্ত কলকাতা। মুক্তমঞ্চকে ঘিরে থাকা ভিড়ের মধ্যে তখন পিন পড়ার নিস্তব্ধতা। পড়ন্ত বিকেলে স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে পুত্রহারা ওই মহিলা বলে চলেছেন, "আমতেল মাখা মুডি নিয়ে বাপ-ব্যাটা দু'জনেই কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে মাঠে গিয়েছিল তিল ঝাড়াই করতে। স্বামী বাড়ি ফিরল। ছেলে ফিরল না। ১৯ বছরের তরতাজা ছেলেটাকে হাত-পা ভেঙে, গুলি করে, ভোজালি দিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলল বিএসএফ। ঝড়-জলের রাতে তন্নতন্ন করে কোথাও খুঁজে পাইনি। যখন পাওয়া গেল তখন ছেলের মুখটা পর্যন্ত দেখতে দিল না গো। চুরি, ছিনতাই, খুন, পাচার- ও তো কিছুই করেনি। তাহলে কেন আমার ছেলেকে ওরা শেষ করে দিল? এই খুনের বিচার চাই। আপনারা বিচার দেবেন না?"
দিনভর এমন নানা অভিজ্ঞতার কথা নিজের মুখে শুনিয়েছিলেন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা লোকজন। বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে কলকাতার অ্যাকোডমি অব ফাইন আর্টসের সামনের ওই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ।
সংস্থার সম্পাদক কিরীটী রায় বলছিলেন, "ছিটমহলে প্রতিনিয়ত লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকার। সেই যন্ত্রণার কথা সবাইকে জানাতে এমন আয়োজন।''
সেই মঞ্চেই মুর্শিদাবাদের সীমান্তঘেঁষা গ্রামেরই এক পুত্রহারা মহিলা কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেছিলেন। ২০১০ সালে তাঁর ছেলেকে বিএসএফ মেরে ফেলে বলে তাঁর অভিযোগ। সেই খুনের বিচার চেয়ে বছর তিনি লড়াই করে চলেছেন। এই অনুষ্ঠানের কথা শুনে আর দেরি করেননি সীমান্তের ওই মহিলা। দিনের দিন পৌঁছতে পারবেন না বলে আগের রাতেই বহরমপুর থেকে শিয়ালদহের ট্রেন ধরেছিলেন। রাতভোরেই পৌঁছে গিয়েছেন কলকাতায়। পরনে নতুন সুতির ছাপা শাড়ি। স্টিকারটা পর্যন্ত তুলতে ভুলে গিয়েছিলেন। কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। ফের নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছেন, "এ লড়াইয়ে আমাকে জিততেই হবে। না হলে মরেও যে শান্তি পাব না।"
মুর্শিদাবাদের ওই মহিলা একা নন, উত্তর ২৪ পরগনা থেকে এসেছিলেন এক প্রৌঢ়া।
নুন আনতে ভাত ফুরনো সংসারে পোষা ছাগলের জন্য 'বর্ডারে' গিয়েছিলেন পাতা আনতে। অভিযোগ, পাতা জোটেনি, জুটেছিল বিএসএফের বেধড়ক মার। হাসপাতালে ভর্তিও ছিলেন বেশ কয়েক দিন। সে দিন মঞ্চে দাঁড়িয়ে ওই প্রৌঢ়া বলছিলেন, "বিএসএফ তো আমাদের মানুষ বলেই মনে করে না। বর্ডারের মানুষের কি বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও নেই?" অধিকার? এ বড জটিল প্রশ্ন? রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করতে হয় সমঝে! না হলে বিপদ বোড বই কমে না! কেমন বিপদ? প্রান্তবাসীরা জানাচ্ছেন, তাঁদের অবস্থা শাঁখের করাতের মতো। যেতেও কাটে। আসতেও। এক দিকে বিএসএফের সন্দেহ। অন্য দিকে ও পার থেকে আসা লোকজনের চোখরাঙানি। কাঁটাতারের ওপারে রয়েছে বিঘের পর বিঘে ভারতীয় জমি। রয়েছে ভারতীয় গ্রাম। বিএসেফের অনুমতি নিয়ে সেখানে চাষ করতেও
যেতে হয়।
পাশাপাশি শুয়ে রয়েছে দু'টো স্বাধীন দেশের জমি। সেখানে চাষ করছেন দু'দেশের গরিব চাষি। জমির একই আলে রাখা থাকছে দু'দেশ থেকে আনা জলখাবার। সে খাবার ভাগ করে খান দু'জনেই। খেতে খেতে সুখ-দুঃখের কত গল্প। কিন্তু কাজ করার সময় এক জন আড চোখে দেখে নেন আর এক জনকে। এক জনের মনে হয়, ''ওর হাতের কাস্তেটা কি আজ বেশি চকচক করছে?''
এমন অবিশ্বাস, এমন সন্দেহ, এমন ভয় নিয়েই বেঁচে থাকতে হয় প্রান্তবাসীদের। বিএসএফ মনে করে, এ ব্যাটার সঙ্গে নির্ঘাত ও পারের কারও যোগাযোগ আছে। আটপৌরে লোকটা ভয় পান, রাতের অন্ধকারে সীমান্ত পেরিয়ে গ্রামে ঢুকে তাঁর গলায় কেউ যে ওই ধারালো কাস্তেটা ধরে বসবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? এমন কত ঘটনা ঘটেছে। ও দেশ থেকে এসে খুন করে চলে গিয়েছে দুষ্কৃতী। চরের মাঠে কাজ করতে গিয়েছেন তরতাজা যুবক। ভরসন্ধ্যায় ফিরে এসেছে তাঁর নিথর দেহ। চোরাপাচারের রমরমা। পাচারকারীরা তখন ফুলেফেঁপে উঠেছে। হাতে অঢেল কাঁচা টাকা। দু'হাতে সে টাকা খরচ হচ্ছে সীমান্তের গ্রামে। যা দেখে চোখ টাটিয়ে গিয়েছে বহু লোকের। বিশ্বাস করে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন ও পার বাংলার কোনও যুবকের সঙ্গে। এ দেশে একটা নিশ্চিন্ত েডরার জন্য হাসতে হাসতে বিয়ে করেছে ভিনদেশি সেই যুবকও। থেকে গিয়েছেন শ্বশুরবাডিতে।
তার পর?
এক দিন বিএসএফের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছে সেই যুবকের শরীর। পাথরের মতো স্থির চোখে সেই দেহের দিকে তাকিয়ে বসে থেকেছেন অভাবি পরিবারের সেই মেয়ে। বিছানায় নাগোড কেঁদে চলেছে তাঁর দুই নাবালক। মুরুটিয়া সীমান্তের সেই মহিলা বলছেন, ''বাবা-মায়ের কথা ফেলতে পারিনি। বিয়েটা করেছিলাম। বহু বার ওকে বলেছিলাম, পাপের কারবার ছেেড দিতে। কথা শোনেনি। মাঝখান থেকে সব ছারখার হয়ে গেল।''
তাই বলে কিন্তু হাল ছেেড দেননি সীমান্তের ওই মহিলা। কষ্ট করে বড করেছেন ছেলে দু'টোকে। অনেক দিন পর্যন্ত যে ছেলে দু'টো জানতে চেয়েছে, তাঁদের আব্বা কোথায়? কী ভাবে মারা গিয়েছে? তাদের দাদা-দাদি কোথায়? ইদে তাঁরা কেউ আসে না কেন? তাদের আব্বা কি সেমুই খেতে ভালবাসত? এখন তারা সত্যিটা জানে। সেটা মেনেও নিয়েছে। দিনভর তারা পরিশ্রম করে। তাদের একটাই লক্ষ্য- আম্মা যেন ভাল থাকে। আম্মা যেন খুশি হয়। আম্মাকে যেন আর কাঁদতে না হয়! সীমান্তে এমন বহু ছেলেমেয়ে আছে যাঁরা পিতৃপরিচয় ছাডাই বড হয়েছে। বড হচ্ছে। কারণ, তাঁদের বাবার কডা নির্দেশই ছিল-অকারণে কোথাও বাপের নাম বলার দরকার নেই। সে নাম লেখা আছে শুধু পুলিশ, বিএসএফ, হাসপাতাল কিংবা মর্গে।
আর যাঁরা এ পার থেকে বিয়ে করে ও পারে চলে গিয়েছে? 'মাঝে মাঝেই আসব' বলেও আসা হয়নি দু'দশ বছর। তাঁদের খবর কেউ জানে না। শুধু ঘোলাটে চোখে বৃদ্ধা চেয়ে থাকেন বাডির পাশ দিয়ে বয়ে চলা কাঁটাতারের দিকে। ওই দূরে, খেতের পিছন থেকে শাডিপরা একটা মেয়ে কি হেঁটে আসছে? মুখটা আবছা। হাঁটাচলা অবিকল তাঁর মেয়ের মতো। রোজ এই একই ভুল তিনি করেন। করেই চলেন। বাডির লোকজন বর্ডারের রাস্তায় এসে বকাঝকা করেন, ''এই বয়সে একা একা রাস্তায় কেন চলে আসো? কত বার তোমাকে নিষেধ করেছি?'' শেষ শ্রাবণে বৃষ্টি নামে। ধুয়ে যায় বৃদ্ধার চোখের জল। শুধু গলার কাছে নোনতা ভাবটা কাটতেই চায় না।
গ্রামের শেষ প্রান্ত দিয়ে বয়ে চলেছে তিরতিরে মাথাভাঙা। ও পারে মহিষকুণ্ডি, জামালপুর। জিলা কুষ্টিয়া। বাংলাদেশ। ও পারের ঘাটে স্নান করতে এসে প্রশ্নটা ছুেড দেন কেউ, ''কী কর্তা, স্বাধীনতা দিবসে আপনারা কী কইরত্যাসেন?'' এ পার থেকে ম্লান গলায় উত্তর যায়, ''ওই যেমন হয় ফি বছর। ইস্কুলে পতাকা তুলবে মাস্টাররা। ছেলেপুলেরা থাকবে। আমাদের আর স্বাধীন হওয়া হল কই!''
ভৌগোলিক ভাবে চরমেঘনা আর পাঁচটা গ্রামের মতো নয়। হোগলবেডিয়ার মেঘনা বিএসএফ ক্যাম্প থেকে প্রায় একশো মিটার দূরে ইন্দো-বাংলাদেশ বর্ডার রোড। কাঁটাতারের বেডা। রাস্তার এ পাশে বিএসএফের নজরদারি চৌকি। সেখানে ভোটার কার্ড দেখিয়ে, প্রশ্নবাণ সামলে বিএসএফের অনুমতি মিললে তবেই ছাডপত্র মেলে সে গ্রামে যাওয়ার। কাঁটাতারের গায়ের লোহার গেট পেরিয়ে থেকে প্রায় দেড কিলোমিটার দক্ষিণে এগিয়ে গেলে চরমেঘনা। তার পরে মাথাভাঙা। গ্রাম থেকে বেরনোর ক্ষেত্রেও একই নিয়ম। সবথেকে বড কথা, সন্ধ্যার পরে বন্ধ হয়ে যায় কাঁটাতারের গায়ের ওই লোহার গেট। দেশে থেকেও যেন দেশের বাইরে। দুই স্বাধীন দেশের মাঝে অসহায় ভাবে জেগে থাকে চরমেঘনা। গ্রামের বাসিন্দা অনিমেষ মাহাতো বলছেন, ''কী ভাগ্য করে যে এই গ্রামে জন্মেছিলাম! উত্তরবঙ্গে ছিটমহলগুলোরও একটা হিল্লে হল। অথচ আমাদের কিছুই হল না। আমাদের দাবি তো বেশি কিছু নয়। শুধু বলছি, কাঁটাতারটা গ্রামের বাইরে দিয়ে দিতে। সরকার যদি সে কথাটাও কানে না তোলে, কী করব বলুন তো?'' তাঁর আক্ষেপ, ''সব থেকে বড কথা কী জানেন তো? স্বাধীন দেশে বাস করেও এই পরাধীনতার যন্ত্রণাটা আর মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। যাঁদের সামর্থ্য আছে তাঁরা এখানকার পাট চুকিয়ে দিয়ে কাঁটাতারের ও পারের গ্রামে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু সে ক্ষমতাও তো আর সকলের নেই।''
তবুও এ গ্রামেও স্বাধীনতা দিবস আসে। বছর কয়েক আগে আসা বিদ্যুতের সৌজন্যে টিভিতে চলে নানা অনুষ্ঠান। প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। হাঁ করে সে সব শোনে চরমেঘনা। তারপর ফের ভোটার কার্ডটা পকেটে নিয়ে বাজারে বেরোয় চাষি। লজঝেড সাইকেল নিয়ে কাঁটাতার ডিঙিয়ে সত্যিকারের স্বাধীন দেশে টিউশন নিতে যায় স্কুলবালিকা। দূরে কোথাও তখনও মাইকে বেজে চলে-জয় হো...।
ছবি গৌতম প্রামাণিক ও সাফিউল্লা ইসলাম
অঙ্কন সুমন চৌধুরী

রবিবার, ১৩ আগস্ট, ২০১৭

সোনা ব্যাঙের বিয়ে

মুহম্মদ কবীর সরকার
সোনা ব্যাঙের বিয়ে হবে
দিলো নিমন্ত্রন,
বাজবে সানাই বর্ষা বরণ
অাসবে সর্বজন।

কুনো দাদা সংগে করে
নিয়ে এলো ছাতা,
উপহারে ভরে গেল
বিয়ে বলে কথা।

টুনটুনিয়ে গুনগুনিয়ে
বললো দুটো ধাঁ ধাঁ
এই ধাঁ ধাঁ না ভেঙ্গে দিলে
বর ছেলেরা গাধাঁ।

ধাঁধাঁ শুনে জামাই বাবু
চুপসে গেলো হায়,
ধাঁ ধাঁয় ফেলে কনের সখি
হাজার কড়ি চায়।
ঘাসফড়িং ও গঙ্গাফড়িং
সেই তালে দেয় নাচ,
কনের বাড়ি সুর উঠালো
ফেলে সবাই কাজ।

ঘ্যাঙর ঘ্যাঙে প্রণয় সুরে
ডাকলো যখন ব্যাঙ,
ওমনি এলো বৃষ্টি নেমে
মারলো শিয়াল ল্যাঙ।

শিয়াল গুরু দৌড়ে পালায়
ছাতা গেলো উড়ে,
'শুভ দৃষ্টি' লগন শেষে
বিয়ে র'লো পরে।
মাছি এসে ভন ভনিয়ে
নাকি সুরে বলে,
বিয়ে হবে কোলা ব্যাঙের
বৃষ্টি গেলো চলে।

'শুনেন সবে' ডাকলো ইঁদুর
দৃষ্টি অাকর্ষণ,
বৃষ্টি গেলো অাবার এলো
বিয়ের এ ল-গ-ন।

রচনাকাল:২০/০৩/২০১৭ইং
সাগরিকা, চট্টগ্রাম।

অবাক জলপান

সুকুমার রায়
পাত্রগণ
পথিক ছোকরা
প্রথম বৃদ্ধ খোকা
দ্বিতীয় বৃদ্ধ মামা
[ ছাতা মাথায় এক পথিকের প্রবেশ, পিঠে লাঠির আগায় লোট-বাঁধা পুঁটলি, উস্কোখুস্কো চুল্, শ্রান্ত চেহারা ]
পথিক : নাঃ— একটু জল না পেলে আর চলছে না । সেই সকাল থেকে হেঁটে আসছি, এখনও প্রায় এক ঘণ্টার পথ বাকি । তেষ্টায় মগজের ঘিলু শুকিয়ে উঠল । কিন্তু জল চাই কার কাছে ? গেরস্তের বাড়ি দুপুর রোদে দরজা এঁটে সব ঘুম দিচ্ছে, ডাকলে সাড়া দেয় না । বেশি চেঁচাতে গেলে হয়তো লোকজন নিয়ে তেড়ে আসবে । পথেও ত লোকজন দেখছিনে ।‒ ঐ একজন আসছে ! ওকেই জিজ্ঞেস করা যাক ।
[ ঝুড়ি মাথায় এক ব্যক্তির প্রবেশ ]
পথিক : মশাই, একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন ?
ঝুড়িওয়ালা : জলপাই ? জলপাই এখন কোথায় পাবেন ? এ ত জলপাইয়ের সময় নয় । কাঁচা আম নিতে চান দিতে পারি‒
পথিক : না না, আমি তা বলিনি‒
ঝুড়িওয়ালা : না, কাঁচা আম আপনি বলেননি, কিন্তু জলপাই চাচ্ছিলেন কিনা, তা ত আর এখন পাওয়া যাবে না, তাই বলছিলুম‒
পথিক : না হে আমি জলপাই চাচ্ছিনে‒
ঝুড়িওয়ালা : চাচ্ছেন না ত 'কোথায় পাব' 'কোথায় পাব' কচ্ছেন কেন ? খামকা এরকম করবার মানে কি ?
পথিক : আপনি ভুল বুঝেছেন‒ আমি জল চাচ্ছিলাম‒
ঝুড়িওয়ালা : জল চাচ্ছেন তো 'জল' বললেই হয়‒ 'জলপাই' বলবার দরকার কি ? জল আর জলপাই কি এক হল ? আলু আর আলুবোখরা কি সমান ? মাছও যা মাছরাঙাও তাই ? বরকে কি আপনি বরকন্দাজ বলেন ? চাল কিনতে এসে চালতার খোঁজ করেন ?
পথিক : ঘাট হয়েছে মশাই । আপনার সঙ্গে কথা বলাই আমার অন্যায় হয়েছে ।
ঝুড়িওয়ালা : অন্যায় তো হয়েছেই । দেখছেন ঝুড়ি নিয়ে যাচ্ছি‒ তবে জলই বা চাচ্ছেন কেন ? ঝুড়িতে করে কি জল নেয় ? লোকের সঙ্গে কথা কইতে গেলে একটু বিবেচনা করে বলতে হয় ।
পথিক : দেখলে ! কি কথায় কি বানিয়ে ফেললে ! যাক, ঐ বুড়ো আসছে, ওকে একবার বলে দেখি ।
[ লাঠি হাতে, চটি পায়ে চাদর গায়ে এক বৃদ্ধের প্রবেশ ]
বৃদ্ধ : কে ও ? গোপ্লা নাকি ?
পথিক : আজ্ঞে না, আমি পুবগাঁয়ের লোক‒ একটু জলের খোঁজ কচ্ছিলুম‒
বৃদ্ধ : বল কিহে ? পুবগাঁও ছেড়ে এখেনে এয়েছ জলের খোঁজ করতে ? ‒ হাঃ, হাঃ, হাঃ । তা, যাই বল বাপু, অমন জাল কিন্তু কোথাও পাবে না । খাসা জল, তোফা জল, চমৎকা-র-র জল ।
পথিক : আজ্ঞে হাঁ, সেই সকাল থেকে হাঁটতে হাঁটতে বেজায় তেষ্টা পেয়ে গেছে ।
বৃদ্ধ : তা ত পাবেই । ভালো জল যদি হয়, তা দেখলে তেষ্টা পায়, নাম করলে তেষ্টা পায়, ভাবতে গেলে তেষ্টা পায় । তেমন তেমন জাল ত খাওনি কখনো ! - বলি ঘুম্ড়ির জল খেয়েছো কোনোদিন ?
পথিক : আজ্ঞে না, তা খাইনি-
বৃদ্ধ : খাওনি ? অ্যাঃ ! ঘুম্ড়ি হচ্ছে আমার মামাবাড়ি‒ আদত জলের জায়গা । সেখানকার যে জল, সে কি বলব তোমায় ? কত জল খেলাম‒ কলের জল, নদীর জল, ঝরণার জল, পুকুরের জল‒ কিন্তু মামাবাড়ির কুয়োর যে জল, অমনটি আর কোথাও খেলাম না । ঠিক যেন চিনির পানা, ঠিক যেন কেওড়া-দেওয়া সরবৎ !
পথিক : তা মশাই আপনার জল আপনি মাথায় করে রাখুন‒ আপাতত এখন এই তেষ্টার সময়, যা হয় একটু জল আমার গলায় পড়লেই চলবে‒
বৃদ্ধ : তাহলে বাপু তোমার গাঁয়ে বসে জল খেলেই ত পারতে ? পাঁচ ক্রোশ পথ হেঁটে জল খেতে আসবার দরকার কি ছিল ? 'যা হয় একটা হলেই হল' ও আবার কি রকম কথা ? আর অমন তচ্ছিল্য করে বলবারই বা দরকার কি ? আমাদের জল পছন্দ না হয়, খেও না- বাস্ । গায়ে পড়ে নিন্দে করবার দরকার কি ? আমি ওরকম ভালোবাসিনে । হ্যাঁঃ-
[ রাগে গজগজ করিতে করিতে বৃদ্ধের প্রস্থান ]
[ পাশের এক বাড়ির জানলা খুলিয়া আর এক বৃদ্ধের হসিমুখ বাহির করণ ]
বৃদ্ধ : কি হে ? এত তর্কাতর্কি কিসের ?
পথিক : আজ্ঞে না, তর্ক নয় । আমি জল চাইছিলুম, তা উনি সে কথা কানেই নেন না- কেবলই সাত পাঁচ গপ্প করতে লেগেছেন । তাই বলতে গেলুম ত রেগে মেগে অস্থির !
বৃদ্ধ : আরে দূর দূর ! তুমিও যেমন ! জিজ্ঞেস করবার আর লোক পাওনি ? ও হতভাগা জানেই বা কি, আর বলবেই বা কি ? ওর যে দাদা আছে, খালিপুরে চাকরি করে, সেটা ত একটা গাধা । ও মুখ্যুটা কি বললে তোমায় ?
পথিক : কি জানি মশাই- জলের কথা বলতেই কুয়োর জাল, নদীর জাল, পুকুরের জল, কলের জল, মামাবাড়ির জল, ব'লে পাঁচ রকম ফর্দ শুনিয়ে দিলে-
বৃদ্ধ : হুঁঃ ‒ ভাবলে খুব বাহাদুরি করেছি । তোমায় বোকা মতন দেখে খুব চাল চেলে নিয়েছে । ভারি ত ফর্দ করেছেন । আমি লিখে দিতে পারি, ও যদি পাঁচটা জল বলে থাকে তা আমি এক্ষুনি পঁচিশটা বলে দেব-
পথিক : আজ্ঞে হ্যাঁ । কিন্তু আমি বলছিলুম কি একটু খাবার জল‒
বৃদ্ধ : কি বলছ ? বিশ্বাস হচ্ছে না ? আচ্ছা শুনে যাও । বিষ্টির জল, ডাবের জল, নাকের জল, চোখের জল, জিবের জল, হুঁকোর জল, ফটিক জল, রোদে ঘেমে জ-ল, আহ্লাদে গলে জ‒ল, গায়ের রক্ত জ‒ল, বুঝিয়ে দিলে যেন জ-ল ‒ কটা হয় ? গোনোনি বুঝি ?
পথিক : না মশাই, গুনিনি‒ আমার আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই‒
বৃদ্ধ : তোমার কাজ না থাকলেও আমাদের কাজ থাকতে পারে ত ? যাও, যাও, মেলা বকিও না । ‒একেবারে অপদার্থের একশেষ ! [ সশব্দে জানলা বন্ধ ]
পথিক : নাঃ, আর জলটল চেয়ে কাজ নেই‒ এগিয়ে যাই, দেখি কোথাও পুকুরটুকুর পাই কি না ।
[ লম্বা লম্বা চুল, চোখে সোনার চশমা, হাতে খাতা পেন্সিল, পায়ে কটকী জুতা, একটি ছোকরার প্রবেশ ]
লোকটা নেহাৎ এসে পড়েছে যখন, একটু জিজ্ঞাসাই করে দেখি । মশাই, আমি অনেক দূর থেকে আসছি, এখানে একটু জল মিলবে না কোথাও?
ছোকরা : কি বলছেন ? 'জল' মিলবে না ? খুব মিলবে । একশোবার মিলবে ! দাঁড়ান, এক্ষুনি মিলিয়ে দিচ্ছি‒ জল চল তল বল কল ফল ‒ মিলের অভাব কি ? কাজল-সজল-উজ্জ্বল জ্বলজ্বল-চঞ্চল চল্ চল্ , আঁখিজল ছল্ছল্ , নদীজল কল্কল্ , হাসি শুনি খল্খল্sঅ্যাঁকানল বাঁকানল, আগল ছাগল পাগল‒ কত চান ?
পথিক : এ দেখি আরেক পাগল ! মশাই, আমি সে রকম মিলবার কথা বলিনি ।
ছোকরা : তবে কি রকম মিল চাচ্ছেন বলুন ? কি রকম, কোন ছন্দ, সব বলে দিন‒ যেমনটি চাইবেন তেমনটি মিলিয়ে দেব ।
পথিক : ভালো বিপদেই পড়া গেল দেখছি‒ (জোরে) মশাই ! আর কিছু চাইনে, ‒(আরো জোরে)sশুধু একটু জল খেতে চাই !
ছোকরা : ও বুঝেছি । শুধু-একটু-জল-খেতে-চাই । এই ত ? আচ্ছা বেশ । এ আর মিলবে না কেন ?‒ শুধু একটু জল খেতে চাই ‒ভারি তেষ্টা প্রাণ আই-ঢাই । চাই কিন্তু কোথা গেলে পাই‒বল্ শীঘ্র বল্ নারে ভাই । কেমন ? ঠিক মিলেছে ত ?
পথিক : আজ্ঞে হ্যাঁ, খুব মিলেছে‒খাসা মিলেছে‒ নমস্কার । (সরিয়া গিয়া) নাঃ, বকে বকে মাথা ধরিয়ে দিলে‒ একটু ছায়ায় বসে মাথাটা ঠাণ্ডা কনে নি । [একটা বাড়ির ছায়ায় গিয়া বসিল]
ছোকরা : (খুশী হইয়া লিখিতে লিখিতে) মিলবে না ? বলি, মেলাচ্ছে কে ? সেবার যখন বিষ্টুদাদা 'বৈকাল' কিসের সঙ্গে মিল দেবে খুঁজে পাচ্ছিল না, তখন 'নৈপাল' বলে দিয়েছিল কে ? নৈপাল কাকে বলে জানেন ত ? নেপালের লোক হল নৈপাল । (পথিককে না দেখিয়া) লোকটা গেল কোথায় ? দুত্তোরি ! [প্রস্থান]
[ বাড়ির ভিতরে বালকের পাঠ‒ পৃথিবীর তিন ভাগ জল এক ভাগ স্থল । সমুদ্রের জল লবণাক্ত, অতি বিস্বাদ ]
পথিক : ওহে খোকা ! একটু এদিকে শুনে যাও ত ?
[ রুক্ষমুর্তি, মাথায় টাক, লম্বা দাড়ি খোকার মামা বাড়ি হইতে বাহির হইলেনs]
মামা : কে হে ? পড়ার সময় ডাকাডাকি করতে এয়েছ?‒ (পথিককে দেখিয়া) ও ! আমি মনে করেছিলুম পাড়ার কোন ছোকরা বুঝি । আপনার কি দরকার?
পথিক : আজ্ঞে , জল তেষ্টায় বড় কষ্ট পাচ্ছি‒ তা একটু জলের খবর কেউ বলতে পারলে না ।
মামা : (তাড়াতাড়ি ঘরের দরজা খুলিয়া) কেউ বলতে পারলে না ? আসুন, আসুন । কি খবর চান, কি জানতে চান, বলুন দেখি ? সব আমায় জিজ্ঞেস করুন, আমি বলে দিচ্ছি । [ ঘরের মধ্যে টানিয়া লওন‒ ভিতরে নানারকম যন্ত্র, নকশা, রাশি রাশি বই ]
কি বলছিলেন ? জলের কথা জিজ্ঞেস করছিলেন না?
পথিক : আজ্ঞে হ্যাঁ, সেই সকাল থেকে হাঁটতে হাঁটতে আসছি‒
মামা : আ হা হা ! কি উৎসাহ ! শুনেও সুখ হয় । এ রকম জানবার আকাঙ্খা কজনের আছে, বলুন ত? বসুন ! বসুন ! [ কতকগুলি ছবি, বই আর এক টুকরা খড়ি বাহির করিয়া ] জলের কথা জানতে গেলে প্রথমে জানা দরকার, জল কাকে বলে, জলের কি গুণ‒
পথিক : আজ্ঞে, একটু খাবার জল যদি‒
মামা : আসছে‒ ব্যস্ত হবেন না । একে একে সব কথা আসবে । জল হচ্ছে দুই ভাগ হাইড্রোজেন আর এক ভাগ অক্সিজেন‒ [ বোর্ডে খড়ি দিয়া লিখিলেন ]
পথিক : এই মাটি করেছে !
মামা : বুঝলেন? রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় জলকে বিশ্লেষণ করলে হয়‒ হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন । আর হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের রাসায়নিক সংযোগ হলেই হল জল ! শুনছেন ত?
পথিক : আজ্ঞে হ্যাঁ, সব শুনছি । কিন্তু একটু খাবার জল যদি দেন, তাহলে আরো মন দিয়ে শুনতে পারি ।
মামা : বেশ ত ! খাবার জলের কথাই নেওয়া যাক না । খাবার জল কাকে বলে ? না, যে জল পরিস্কার, স্বাস্থকর, যাতে দুর্গন্ধ নাই, রোগের বীজ নাই‒ কেমন ? এই দেখুন এক শিশি জল‒ আহা, ব্যস্ত হবেন না । দেখতে মনে হয় বেশ পরিস্কার, কিন্তু অনুবীক্ষন দিয়ে যদি দেখেন, দেখবেন পোকা সব কিলবিল করছে । কেঁচোর মতো, কৃমির মতো সব পোকা‒ এমনি চোখে দেখা যায় না, কিন্তু অনুবীক্ষন দিয়ে দেখায় ঠিক এত্তো বড় বড় । এই বোতলের মধ্যে দেখুন, ও বাড়ির পুকুরের জল; আমি এইমাত্র পরীক্ষা করে দেখলুম; ওর মধ্যে রোগের বীজ সব গিজ্গিজ্ করছে‒ প্লেগ, টইফয়েড, ওলাউঠা, ঘেয়োজ্বর ‒ও জল খেয়েছেন কি মরেছেন ! এই ছবি দেখুন‒ এইগুলো হচ্ছে কলেরার বীজ, এই ডিপথেরিয়া, এই নিউমোনিয়া, ম্যালেরিয়া ‒সব আছে । আর এই সব হচ্ছে জলের পোকা‒ জলের মধ্যে শ্যাওলা ময়লা যা কিছু থাকে ওরা সেইগুলো খায় । আর এই জলটার কি দুর্গন্ধ দেখুন ! পচা পুকুরের জল‒ ছেঁকে নিয়েছি, তবু গন্ধ ।
পথিক : উঁ হুঁ হুঁ হুঁ ! করেন কি মশাই ? ওসব জানবার কিচ্ছু দরকার নেই‒
মামা : খুব দরকার আছে । এসব জানতে হয়‒ অত্যন্ত দরকারী কথা !
পথিক : হোক দরকারী‒ আমি জানতে চাইনে, এখন আমার সময় নেই‒
মামা : এই ত জানবার সময় । আর দুদিন বাদে যখন বুড়ো হয়ে মরতে বসবেন, তখন জেনে লাভ কি ? জলে কি কি দোষ থাকে, কি করে সে সব ধরতে হয়, কি করে তার শোধন হয়, এসব জানবার মতো কথা নয় ? এই যে সব নদীর জল সমুদ্রে যাচ্ছে, সমুদ্রের জল সব বাস্প হয়ে উঠছে, মেঘ হচ্ছে, বৃষ্টি পড়ছে‒ এরকম কেন হয়, কিসে হয়, তাও ত জানা দরকার?
পথিক : দেখুন মশাই ! কি করে কথাটা আপনাদের মাথায় ঢোকাব তা ত ভেবে পাইনে। বলি, বারবার করে বলছি‒ তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল, সেটা ত কেউ কানে নিচ্ছেন না দেখি। একটা লোক তেষ্টায় জল-জল করছে তবু জল খেতে পায় না, এরকম কোথাও শুনেছেন?
মামা : শুনেছি বৈকি‒ চোখে দেখেছি । বদ্যিনাথকে কুকুরে কামড়াল, বদ্যিনাথের হল হাইড্রোফোবিয়া‒ যাকে বলে জলাতঙ্ক। আর জল খেতে পারে না‒ যেই জল খেতে যায় অমনি গলায় খিঁচ ধরে যায়। মহা মুশকিল !‒ শেষটায় ওঝা ডেকে, ধুতুরো দিয়ে ওষুধ মেখে খওয়ালো, মন্তর চালিয়ে বিষ ঝাড়ল‒ তারপর সে জল খেয়ে বাঁচল। ওরকম হয়।
পথিক : নাঃ‒ এদের সঙ্গে আর পেরে ওঠা গেল না‒ কেনই বা মরতে এসেছিলাম এখেনে? বলি, মশাই, আপনার এখানে নোংরা জল আর দুর্গন্ধ জল ছাড়া ভালো খাঁটি জল কিছু নেই?
মামা : আছে বৈকি! এই দেখুন না বোতলভরা টাটকা খাঁটি 'ডিস্টিল ওয়াটার'‒ যাকে বলে 'পরিশ্রুত জল' ।
পথিক : (ব্যস্ত হইয়া) এ জল কি খায়?
মামা : না, ও জল খায় না‒ ওতে স্বাদ নেই‒ একেবারে বোবা জল কিনা, এইমাত্র তৈরি করে আনল‒ এখনো গরম রয়েছে।
[ পথিকের হতাশ ভাব ]
তারপর যা বলছিলাম শুনুন‒ এই যে দেখছেন গন্ধওয়ালা নোংরা জল‒ এর মধ্যে দেখুন এই গোলাপী জল ঢেলে দিলুম‒ বাস, গোলাপী রঙ উড়ে শাদা হয়ে গেল । দেখলেন ত?
পথিক : না মশাই, কিচ্ছু দেখিনি‒ কিচ্ছু বুঝতে পারিনি‒ কিচ্ছু মানি না‒ কিচ্ছু বিশ্বাস করি না।
মামা : কি বললেন ! আমার কথা বিশ্বাস করেন না?
পথিক : না, করি না। আমি যা চাই, তা যতক্ষণ দেখাতে না পারবেন, ততক্ষণ কিচ্ছু শুনব না, কিচ্ছু বিশ্বাস করব না।
মামা : বটে ! কোনটা দেখতে চান একবার বলুন দেখি‒ আমি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছি‒
পথিক : তাহলে দেখান দেখি । শাদা, খাঁটি চমৎকার, ঠাণ্ডা, এক গেলাশ খাবার জল নিয়ে দেখান দেখি । যাতে গন্ধপোকা নেই, কলেরার পোকা নেই, ময়লাটয়লা কিচ্ছু নেই, তা দিয়ে পরীক্ষা করে দেখান দেখি । খুব বড় এক গেলাশ ভর্তি জল নিয়ে আসুন ত।
মামা : এক্ষুনি দেখিয়ে দিচ্ছি‒ ওরে ট্যাঁপা, দৌড়ে আমার কুঁজো থেকে এক গেলাশ জল নিয়ে আয় ত।
[ পাশের ঘরে দুপদাপ শব্দে খোকার দৌড় ]
নিয়ে আসুক তারপর দেখিয়ে দিচ্ছি । ঐ জলে কি রকম হয়, আর এই নোংরা জলে কি রকম তফাৎ হয়, সব আমি এক্সপেরিমেন্ট করে দেখিয়ে দিচ্ছি।
[ জল লইয়া ট্যাঁপার প্রবেশ ]
রাখ এইখানে রাখ।
[ জল রাখিবামাত্র পথিকের আক্রমণ‒ মামার হাত হইতে জল কাড়িয়া এক নিঃশ্বাসে চুমুক দিয়া শেষ ]
পথিক : আঃ ! বাঁচা গেল !
মামা : (চটিয়া) এটা কি রকম হল মশাই?
পথিক : পরীক্ষা হল‒ এক্সপেরিমেন্ট ! এবার আপনি নোংরা জলটা একবার খেয়ে দেখান ত, কি রকম হয়?
মামা : (ভীষণ রাগিয়া) কি বললেন !
পথিক : আচ্ছা থাক, এখন নাই বা খেলেন‒ পরে খবেন এখন । আর এই গাঁয়ের মধ্যে আপনার মতো আনকোরা পাগল আর যতগুলো আছে, সব কটাকে খানিকটা করে খাইয়ে দেবেন । তারপর খাটিয়া তুলবার দরকার হলে আমার খবর দেবেন‒ আমি খুশী হয়ে ছুটে আসব‒ হতভাগা জোচ্চোর কোথাকার ! [ দ্রুত প্রস্থান ]
[ পাশের গলিতে সুর করিয়া কে হাঁকিতে লাগিল‒ 'অবাক জলপান' ]

শনিবার, ১২ আগস্ট, ২০১৭

ছড়ামর্শ

ছড়ামর্শ
জনি হোসেন কাব্য
ছড়ামর্শ, ছড়া লেখার পরামর্শ । এখানে শুধুমাত্র ছড়া নিয়েই কথা হবে । ছড়া এবং কবিতার মধ্যে পার্থক্য আছে । কবিতায় রহস্যময়তা থাকে, কিন্তু ছড়ার বক্তব্য সহজবোধ্য ও স্পষ্ট হ়য় । কবিতা এবং ছড়া দুটোতেই ছন্দ বিদ্যমান । ছড়ামর্শে আমরা শুধু ছড়ার ছন্দ, গঠন, আকার, এবং ছড়া সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন উপাদান সম্পর্কে জানবো । জেনে রাখা জরুরি, ছড়ামর্শে উদাহরণ দেওয়া বেশিরভাগ ছড়াই স্বরবৃত্ত ছন্দের ।
★ এক।
'ছড়া লেখার নিয়মকানুন'
যারা ছড়াজগতে একেবারেই নতুন অথবা ছড়া লেখার নিয়মকানুন আয়ত্বে নেই তাদের জন্যে এই ছড়ামর্শটি । এটি জানা এমন কোনো কঠিন বিষয় নয় । খুবই সহজ, মজার, উপভোগ্য ।
ছন্দ সম্পর্কে জানতে গেলে আমাদেরকে প্রথমেই ছন্দের কিছু উপকরণ সম্পর্কে জানতে হবে ।
ছড়াংশের মাধ্যমে সেসব উপকরণের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি-
'আমের পাতা/ বাঁশের পাতা/ মুড়ে বানাই/ বাঁশি,
মিষ্টি অতীত/ তোমায় ভেবে/ কষ্ট পেয়ে/ হাসি ।'
পর্ব :
ছড়ায় ব্যবহৃত প্রতিটি বাক্যের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তাল বা অংশকে পর্ব বলে ।
উপরোক্ত ছড়াংশটির মাধ্যমে পর্ব চিনতে চেষ্টা করি-
আমের পাতা (এক পর্ব) + বাঁশের পাতা (এক পর্ব) + মুড়ে বানাই (এক পর্ব) +বাঁশি (অন্ত্যমিল পর্ব=এক পর্ব), = চার পর্ব ।
মিষ্টি অতীত (এক পর্ব) + তোমায় ভেবে (এক পর্ব) + কষ্ট পেয়ে (এক পর্ব) + হাসি (অন্ত্যমিল পর্ব = এক পর্ব) ।= চার পর্ব ।
সুতরাং ছড়াংশটির প্রতিটি লাইনই চার পর্বের ।
অন্ত্যমিল :
ছড়ায় ব্যবহৃত একটি বাক্যের শেষ পর্বের সাথে আরেকটি বাক্যের শেষ পর্বের যে মিল তাকে অন্ত্যমিল বলে ।
উদাহরণ দেওয়া ছড়াংশটির মাধ্যমে অন্ত্যমিল চিনতে চেষ্টা করি-
'আমের পাতা/ বাঁশের পাতা/ মুড়ে বানাই/ বাঁশি,
মিষ্টি অতীত/ তোমায় ভেবে/ কষ্ট পেয়ে/ হাসি ।'
এখানে, প্রথম বাক্যের শেষ পর্বটি হচ্ছে 'বাঁশি' এবং দ্বিতীয় বাক্যের শেষ পর্বটি হচ্ছে 'হাসি' । সুতরাং 'হাসি' শব্দের সাথে 'বাঁশি' শব্দের যে মিল সেটিকেই বলা হয় অন্ত্যমিল ।
স্বর :
ছড়াংশে ব্যবহৃত দুটি শব্দ উদাহরণ দিয়ে স্বর দেখাচ্ছি-
পাতা= পা + তা = দুটি স্বর
মিষ্টি= মিষ্ + টি = দুটি স্বর ।
স্বর দু' প্রকার-
১। মুক্তস্বর
২। বদ্ধস্বর
মুক্তস্বর-
যেসব স্বর টেনে স্বাধীনভাবে পড়া যায়, কোথাও আটকে যেতে হয় না, সে সব স্বরকে মুক্তস্বর বলে ।
'পাতা' শব্দটি উচ্চারণ করি-
পা..., তা..., = এখানে, দুটি উচ্চারণ । সুতরাং দুটি স্বর । দুটি স্বরই স্বাধীনভাবে পড়া যায় কোথাও আটকে যেতে হয় না । দুটি স্বরই মুক্তস্বর ।
বদ্ধস্বর-
যেসব স্বর স্বাধীনভাবে পড়া যায় না, পড়তে যেয়ে আটকে যেতে হয়, সেসব স্বরকে বদ্ধস্বর বলে ।
'মিষ্টি' শব্দটি উচ্চারণ করে দেখি-
মি...ষ্, টি... = এখানে দুটি উচ্চারণ । সুতরাং দুটি স্বর । কিন্তু 'মি...ষ্' স্বরটি বদ্ধস্বর । কারণ এই স্বরটি পড়তে গেলে (মি থেকে শুরু করলে ষ্-এ এসে) আটকে যেতে হয় । বাকী 'টি...' স্বরটি স্বাধীনভাবে পড়া যায় তাই এটি মুক্তস্বর ।
মোটামুটি এসব উপকরণ নিয়েই ছন্দ গঠিত হয় । এবার আসি মূল বিষয়ে ।
ছন্দ :
ছড়ার শ্রুতিমধুর বাক্যে সুশৃঙ্খল স্বরবিন্যাসের ফলে যে সৌন্দর্য সৃষ্টি হয় তাকে ছন্দ বলে ।
ছন্দ তিন প্রকার-
১। স্বরবৃত্ত ছন্দ
২। মাত্রাবৃত্ত ছন্দ
৩। অক্ষরবৃত্ত ছন্দ
স্বরবৃত্ত ছন্দ-
ছড়ায় বহুল ব্যবহৃত হয় বলে, এই ছন্দকে ছড়ার ছন্দ বলা হয় । স্বরবৃত্ত ছন্দে স্বরের হিসেব করে মাত্রাগণনা করা হয় । একেকটি স্বর একেকটি মাত্রা । মুক্তস্বর যেমন এক মাত্রা তেমনি বদ্ধস্বরকেও এক মাত্রাই গণনা করা হবে ।
• স্বরবৃত্ত ছন্দের ছড়ায়, প্রতিটি বাক্য চারটি পর্ব নিয়ে গঠিত হয় । চারটি পর্বের পর পর তিনটি পর্বকে বলা হয় মূল পর্ব । আর শেষ পর্ব অর্থাৎ চতুর্থ পর্বকে বলা হয় অন্ত্যমিল পর্ব ।
আগের উদাহরণটি দিয়েই বিশ্লেষণ করা যায়-
'আমের পাতা/ বাঁশের পাতা/ মুড়ে বানাই/ বাঁশি,
মিষ্টি অতীত/ তোমায় ভেবে/ কষ্ট পেয়ে/ হাসি ।'
প্রথম বাক্যে লক্ষ করি,
বাক্যটি চারটি পর্ব নিয়ে গঠিত । প্রথম তিনটি মূল পর্ব । এবং শেষের পর্বটি অন্ত্যমিল পর্ব ।
'আমের পাতা + বাঁশের পাতা + মুড়ে বানাই = তিনটি মূল পর্ব ।
বাঁশি = অন্ত্যমিল পর্ব ।
দ্বিতীয় বাক্যটিও ঠিক একই কাঠামোয় গঠিত ।
সুতরাং প্রতিটি বাক্যের কাঠামো একই হবে ।
• স্বরবৃত্ত ছন্দের ছড়ায়, প্রতিটি বাক্যের মূলপর্বগুলি চার মাত্রার হয় । অন্ত্যমিল পর্বগুলি এক মাত্রার হয়, দুই মাত্রার হয়, তিন মাত্রার, চারমাত্রারও হয়ে থাকে ।
পূর্বের উদাহরণটি দিয়েই বিশ্লেষণ করা যায়-
'আমের পাতা/ বাঁশের পাতা/ মুড়ে বানাই/ বাঁশি,
মিষ্টি অতীত/ তোমায় ভেবে/ কষ্ট পেয়ে/ হাসি ।'
ছড়াংশে প্রতিটি বাক্যের মূলপর্বগুলি চার মাত্রার । আর বাকী অন্ত্যমিল পর্বগুলি দুই মাত্রার ।
প্রথম বাক্যটি বিশ্লেষণ করে দেখাচ্ছি-
'আ(মুক্তস্বর) + মের(বদ্ধস্বর)+ পা(মুক্তস্বর)+তা(মুক্তস্বর) = চারটি স্বর । সুতরাং, চারটি মাত্রা ।
বাঁ(মুক্তস্বর) + শের( বদ্ধস্বর) + পা(মুক্তস্বর) +তা(মুক্তস্বর) = চারটি স্বর । সুতরাং, চারটি মাত্রা ।
মু(মুক্তস্বর) + ড়ে(মুক্তস্বর) + বা(মুক্তস্বর) + নাই(বদ্ধস্বর) = চারটি স্বর । সুতরাং, চারটি মাত্রা ।
বাঁ(মুক্তস্বর) + শি(মুক্তস্বর) = দুটি স্বর। দুটি মাত্রা ।
দ্বিতীয় বাক্যটিও ঠিক একই কাঠামোর ।
ছড়াংশটির পর্ববিন্যাস দাঁড়ায়-
৪+৪+৪+২, (প্রথম বাক্য)
৪+৪+৪+২।(দ্বিতীয় বাক্য)
পরের বাক্যগুলিও ঠিক একই কাঠামোয় গঠিত হবে ।
জেনে রাখা ভালো-
স্বরবৃত্ত ছন্দে " জড়িয়ে/চড়িয়ে/
মাড়িয়ে/তাড়িয়ে/হারিয়ে/জ্বালিয়ে/পালিয়ে/জুড়িয়ে/
পুড়িয়ে/লুকিয়ে/শুকিয়ে/লুটিয়ে" প্রভৃতি শব্দগুলো যদি বাক্যের শুরুতে বা মাঝে থাকে, তাহলে দ্রুতলয় উচ্চারণের কারণে শব্দগুলো তিনমাত্রার হলেও সেসব দুমাত্রা ধরা হবে । আর যদি বাক্যের শেষে থাকে, তাহলে তিনমাত্রা ধরা হবে ।
কবি আল মাহমুদ একটি জনপ্রিয় ছড়ার আটটি লাইন দেখি-
‘আমার কেবল ইচ্ছে করে
নদীর ধারে থাকতে,
বকুল ডালে লুকিয়ে থেকে
পাখির মত ডাকতে ।
সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
কর্ণফুলীর পুলটায়,
দুধ ভরা ঐ চাঁদের বাটি
ফেরেশতারা উল্টায় ।'
এখানে 'লুকিয়ে,ঘুমিয়ে' শব্দদুটি বাক্যের মাঝখানে থাকায় দুমাত্রা ধরা হয়েছে ।
মূলত, স্বরবৃত্ত ছন্দ এগুলাই ।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দ-
মাত্রাবৃত্ত ছন্দে মুক্তস্বর একমাত্রাই । কিন্তু বদ্ধস্বরকে দুই মাত্রা গণনা করা হয় । স্বরবৃত্ত ছন্দের সাথে মাত্রাবৃত্ত ছন্দের পার্থক্য এতটুকুই ।
• স্বরবৃত্ত ছন্দের মতোই মাত্রাবৃত্ত ছন্দের ছড়াতেও, প্রতিটি বাক্য চারটি পর্ব নিয়ে গঠিত হয় । চারটি পর্বের পর পর তিনটি পর্বকে বলা হয় মূল পর্ব । আর শেষ পর্ব অর্থাৎ চতুর্থ পর্বকে বলা হয় অন্ত্যমিল পর্ব ।
উদাহরণ দেওয়া যায়-
'সেই সব/ অতীতকে/ খুঁজে পাবো/ কই,
মনে সাধ/ জাগে ফের/ ছোট্টটি/ হই ।'
• মাত্রাবৃত্ত ছন্দের ছড়ায় প্রতিটি বাক্যের মূলপর্বগুলি চার মাত্রার, ছয়মাত্রার হয়ে থাকে । অন্ত্যমিল পর্ব এক মাত্রার, দুই মাত্রার, তিন মাত্রার, চার মাত্রার হয়ে থাকে ।
প্রতিটি বাক্যের মূলপর্ব চার মাত্রার উদাহরণ -
'সেই সব/ অতীতকে/ খুঁজে পাবো/ কই,
মনে সাধ/ জাগে ফের/ ছোট্টটি/ হই ।'
প্রথম বাক্যটি বিশ্লেষণ করে দেখাচ্ছি-
শুরুতেই বলেছি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে মুক্তস্বর একমাত্রাই । কিন্তু বদ্ধস্বরকে দুই মাত্রা গণনা করা হয় । যাই হোক বিশ্লেষণে যাচ্ছি,
সেই(বদ্ধস্বর=দুটি মাত্রা) + সব(বদ্ধস্বর=দুটি মাত্রা) = চারটি মাত্রা
অ(মুক্তস্বর=একটি মাত্রা) + তীত(বদ্ধস্বর=দুটি মাত্রা) + কে(মুক্তস্বর=একটি মাত্রা) = চারটি মাত্রা
খুঁ(মুক্তস্বর=একটি মাত্রা) + জে(মুক্তস্বর=একটি মাত্রা) পা(মুক্তস্বর=একটি মাত্রা) + বো(মুক্তস্বর=একটি মাত্রা) = চারটি মাত্রা ।
কই,(বদ্ধস্বর=দুটি মাত্রা) = দুটি মাত্রা( অন্ত্যমিল পর্ব)
দ্বিতীয় বাক্যটিও ঠিক একই কাঠামোর ।
ছড়াংশটির পর্ববিন্যাস দাঁড়ায়-
৪+৪+৪+২,
৪+৪+৪+২ ।
পরের বাক্যগুলিও ঠিক একই কাঠামোয় গঠিত হবে ।
প্রতিটি বাক্যের মূলপর্ব ছয় মাত্রার উদাহরণ -
'এইখানে তোর/ দাদির কবর/ ডালিম গাছের/ তলে,
তিরিশ বছর/ ভিজিয়ে রেখেছি/ দুই নয়নের/ জলে ।'
প্রথম বাক্যটি বিশ্লেষণ করি-
'এই(বদ্ধস্বর=দুটি মাত্রা) + খা (মুক্তস্বর) + নে(মুক্তস্বর) তোর(বদ্ধস্বর=দুটি মাত্রা) = ছয় মাত্রা
দা(মুক্তস্বর) + দির(বদ্ধস্বর=দুটি মাত্রা) + ক(মুক্তস্বর) + বর(বদ্ধস্বর=দুটি মাত্রা) = ছয় মাত্রা
ডা(মুক্তস্বর) + লিম(বদ্ধস্বর=দুটি মাত্রা) + গা(মুক্তস্বর) + ছের(বদ্ধস্বর=দুটি মাত্রা) = ছয় মাত্রা
ত(মুক্তস্বর) + লে,(মুক্তস্বর) = দুই মাত্রা (অন্ত্যমিল পর্ব)
ছড়াংশটির পর্ববিন্যাস দাঁড়ায়-
৬+৬+৬+২,
৬+৬+৬+২ ।
পরের বাক্যগুলিও ঠিক একই কাঠামোয় গঠিত হবে ।
মূলত, মাত্রাবৃত্ত ছন্দ এগুলাই ।
ছড়া মূলত স্বরবৃত্ত ছন্দ ও মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা হয় । অক্ষরবৃত্ত ছন্দে তেমন একটা ছড়া রচনা করা হয় না । একেবারে কাঁচা লিখিয়েদের আপাতত অক্ষরবৃত্ত ছন্দ না শিখলেও চলবে।দুই
'বদ্ধমাত্রা এবং মুক্তমাত্রা সঠিক ব্যবহার'
আমরা আগেই জেনেছি স্বর কী ? স্বর এবং মাত্রার মধ্যে পার্থক্য নেই ।
আলোচনার সুবিধার্থে আবারো জেনে নিই স্বর বা মাত্রা কী ?
সহজ করেই বলি, এক ঝোঁকে শব্দের যে অংশটুকু উচ্চারিত হয় তাকে বলে। এই মাত্রা অনেকটাই ইংরেজি Syllable-র মত।
যেমন-
শর্বরী- শর, বো, রী- ৩ মাত্রা
চিরজীবী- চি, রো, জী, বী- ৪ মাত্রা
কুঞ্জ- কুন, জো- ২ মাত্রা
এভাবেই মাত্রা গণনা করা হয় স্বরবৃত্ত ছন্দে ।
মাত্রা দুই প্রকার-
১। মুক্তমাত্রা
২। বদ্ধমাত্রা
মুক্তমাত্রা-
যেসব মাত্রা টেনে স্বাধীনভাবে পড়া যায় কোথাও আটকে যেতে হয় না তাকে মুক্তমাত্রা বলে ।
চিরজীবী শব্দটি উচ্চারণ করে দেখি-
চি..., রো..., জি..., বি..., = এখানে, চারটি উচ্চারণ । সুতরাং চার মাত্রা । চারটি মাত্রাই স্বাধীনভাবে পড়া যায় কোথাও আটকে যেতে হয় না । সুতরাং চারটি মাত্রাই মুক্তমাত্রার ।
বদ্ধমাত্রা-
যেসব মাত্রা স্বাধীনভাবে পড়া যায় না, পড়তে যেয়ে আটকে যেতে হয় তাকে বদ্ধমাত্রা বলে ।
কুঞ্জ শব্দটি উচ্চারণ করে দেখি-
কু...ন্, জো... = এখানে দুটি উচ্চারণ । সুতরাং দুই মাত্রা । কিন্তু 'কু...ন্' মাত্রাটি বদ্ধমাত্রা । কারণ এই মাত্রাটি পড়তে গেলে (কু থেকে শুরু করলে ন্-এ এসে) আটকে যেতে হয় । বাকী 'জো...' মাত্রাটি স্বাধীনভাবে পড়া যায় সুতরাং এটি মুক্তমাত্রা ।
আশা করি, মাত্রা নিয়ে আর কোন কনফিউশন থাকবে না ।
এবার আসি মুল আলোচনায়-
পাশাপাশি তিনটি বদ্ধমাত্রা ব্যবহার হলে সেটি তিন মাত্রায় না থেকে চার মাত্রা হয়ে যায় ।
উদাহরণ দিচ্ছি-
গান গায় অই হিজল বনে
হলুদ পাখির দল,
মন ভরে যায় শুনলে অমন
মিষ্টি কোলাহল ।
ছড়াংশটির কাঠামো বিশ্লেষণ করি-
গান(বদ্ধমাত্রা) গায়(বদ্ধমাত্রা) অই(বদ্ধমাত্রা)=তিনটা বদ্ধমাত্রা সুতরাং ৪ মাত্রা ধরা হয়েছে ।
হি(মুক্তমাত্রা)জল(বদ্ধমাত্রা) ব(মুক্তমাত্রা)নে(মুক্তমাত্রা)/= ৪ মাত্রা
হ(মুক্তমাত্রা)লুদ(বদ্ধমাত্রা) পা(মুক্তমাত্রা)খির(বদ্ধমাত্রা)/= ৪ মাত্রা
দল,(বদ্ধমাত্রার অন্ত্যমিল) /=১ মাত্রা
মন(বদ্ধমাত্রা) ভ(মুক্তমাত্রা)র
ে(মুক্তমাত্রা) যায়(বদ্ধমাত্রা)/=৪ মাত্রা
শুন(বদ্ধমাত্রা)লে(মুক্তমাত্রা) অ(মুক্তমাত্রা)মন(বদ্ধমাত্র)/=৪ মাত্রা
মিষ(বদ্ধমাত্রা)টি(মুক্তমাত্রা)কো(মুক্তমাত্রা)লা(মুক্তমাত্রা)
হল।(বদ্ধমাত্রার অন্ত্যমিল)/=১ মাত্রা
( '/' চিহ্নটি দিয়ে ১টি পর্ব বুঝানো হয়েছে, স্বরবৃত্ত ছন্দে একটি পর্ব চার মাত্রার হয়ে থাকে )
সুতরাং কাঠামো বিন্যাসটি দাঁড়ায়-
৪+৪
৪+১,
৪+৪
৪+১ ।
এটি স্বরবৃত্ত ছন্দের জন্যে প্রতিষ্টিত একটি কাঠামো ।
ছড়াংশটি বিশ্লেষণ করে আমরা মূলত জানতে পারলাম একটি পর্বে তিনটি বদ্ধমাত্রা পাশাপাশি বসালে সেটি তিনমাত্রায় না থেকে চারমাত্রা হয়ে যায় ।
অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, যদি একই পর্বে তিনটি বদ্ধমাত্রা পাশাপাশি না বসে দ্ধমাত্রা+মুক্ত
মাত্রা+বদ্ধমাত্রা+বদ্ধমাত্রা হয় তাহলে কি চার মাত্রা হবে ?
না । তাহলে পাঁচমাত্রা হয়ে যাবে ( যা ছড়াতে ব্যবহার করা একেবারেই উচিৎ নয় ) ।
মোটকথা একই পর্বে তিনটি বদ্ধমাত্রা থাকলেই চারমাত্রা হয়ে যাবে ।
অনেকে একই পর্বে পাশাপাশি দুটি বদ্ধমাত্রা আর দুটি মুক্তমাত্রা (বদ্ধমাত্রা+বদ্ধমাত্রা+মুক্তমাত্রা+মুক্তমাত্রা) ব্যবহার করেন। যা পড়তে শ্রুতিমধুর হয় না । কেননা দুটি বদ্ধমাত্রা পাশাপাশি বসলে দুই মাত্রা না হয়ে তিন মাত্রা হয়ে যায় ।
সুতরাং একটি বদ্ধমাত্রার পর একটি মুক্তমাত্রা ব্যবহার করাই ভালো । ছড়াতে বদ্ধমাত্রার কম প্রয়োগ করলে ছড়া অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠে । তবে প্রতিটি পর্বের প্রথমে (অন্ত্যমিল পর্বে নাই বা থাকলো) একটি বদ্ধমাত্রা রাখতে পারলে ছড়া আরো বেশি ঝরঝরে হয় ।
পর্ব শুরুর প্রথম মাত্রায় বদ্ধমাত্রা না রাখতে পারলে , দ্বিতীয় মাত্রায় বদ্ধমাত্রা রাখা যেতে পারে ।
ফারুক নওয়াজের আকর্ষণীয় একটি ছড়া দেখি-
ছোট্টবেলায় সেই যে শুরু উল্টোমিটা আমার ;
এরপরে আর উল্টোমিটার পাল্টালো না গ্রামার ।
বয়স যখন মাস চারকের দুষ্টু ছিলাম যা-তা...
চৌকি থেকে উল্টে পড়ে প্রথম ফাটাই মাথা ।
সেই ফাটাটা মোছার আগেই বছর দেড়েক হতেই;
রিকশা থেকে গড়িয়ে সোজা উলটে পড়ি পথেই ।
প্রথম গেলাম পাঠশালাতে বাবার আঙুল ধরে...
মোজার সাথে নতুন জুতো উল্টো করে পরে ।
উল্টো করে বই ধরাতে স্যার দিয়েছেন ঝাড়ি,
রাগ করে বেঞ্চ উল্টে ফেলে উল্টো ফিরি বাড়ি ।
উল্টো করে অঙ্ক কষায় গোল্লা পেলাম দু’টো...
উল্টো পেরেক ঠুকতে গিয়ে হাত করেছি ফূটো ।
এমনি করে আজ অবধি উলটপালট সবি;
লিখতে গিয়ে কাব্য হলাম উল্টো পথের কবি ।
সবাই লেখে যেমন করে হয় না তেমন আমার;
আমার লেখা; উল্টো যেমন বোতাম লাগাই জামার ।
সবাই কেমন তড়তড়িয়ে যাচ্ছে উঠে গাছে,
আমার তেমন সয় না বলে থাকছি পড়ে পাছে ।
লেখার মতোই ঘুমাই আমি উলটো করে খাটে,
সবকিছুতেই উলটপালট উলটো জীবন কাটে ।
হয়তো এমন উল্টোমিতে হচ্ছি বিপদমুখী,
বলব তবু উলটো চলেই উল্টো আমি সুখি ।
ছড়াটির বৈশিষ্ট্য -
১। বদ্ধমাত্রার ব্যবহার কম ।
২। প্রায় প্রতিটি পর্ব শুরুর প্রথম মাত্রাটি বদ্ধমাত্রা, মাঝে মাঝে দ্বিতীয় মাত্রাটি বদ্ধমাত্রা রাখা হয়েছে ।
৩। একটি বদ্ধমাত্রা ব্যবহারের পর একটি মুক্তমাত্রা ব্যবহার করা হয়েছে ।
৪। পাশাপাশি দুইটি অথবা তিনটি বদ্ধমাত্রা ব্যবহার করা হয়নি ।
ইত্যাদি ।
ছড়া সতেজ করে তুলতে হলে বদ্ধমাত্রার ব্যবহার কমাতে হবে, ব্যবহার করলেও একটি বদ্ধমাত্রার পর একটি মুক্তমাত্রা জুড়ে দিতে হবে । তবে প্রতিটি পর্বের প্রথমে (অন্ত্যমিল পর্বে নাই বা থাকলো) একটি বদ্ধমাত্রা রাখতে পারলে ছড়া আরো বেশি ঝরঝরে হয় ।
পর্ব শুরুর প্রথম মাত্রায় বদ্ধমাত্রা না রাখতে পারলে , দ্বিতীয় মাত্রায় বদ্ধমাত্রা রাখা যেতে পারে ।
মনে রাখতে হবে, দুটি বদ্ধমাত্রা পাশাপাশি বসলে দুই মাত্রা না হয়ে তিন মাত্রা হয়ে যায় এবং তিনটি বদ্ধমাত্রা পাশাপাশি বসলে তিন মাত্রা না হয়ে চার মাত্রা হয়ে যায়

তিন ।
'অন্ত্যমিলের মাত্রাসমতা'
এখন জানবো, ছড়ায় ব্যবহৃত অন্ত্যমিলের মাত্রা সম্পর্কে ।
আলোচনার সুবিধার্থে আবারো জেনে নিই, অন্ত্যমিল কী? মাত্রা কি?
দুটো ছড়াংশ দিয়ে তা দেখাচ্ছি-
ছড়াংশ- ১
একলা ছিলেম কুয়োর ধারে নিমের ছায়া তলে,
কলস নিয়ে সবাই তখন পাড়ায় গেছে চলে ∣∣
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
ছড়াংশ- ২
ভুড়িভোজের পরে সবাই ধরলো এমন গান ,
সে গান শুনে বরও কনের ফেটেই গেলো কান।
(নাজিয়া ফেরদৌস)
ছড়াংশ- ১ এ, প্রথম বাক্যের 'তলে' এবং দ্বিতীয় বাক্যের 'চলে' অথবা ছড়াংশ-২ এ প্রথম বাক্যের 'গান' দ্বিতীয় বাক্যের 'কান' হচ্ছে অন্ত্যমিল ।
ছড়াংশ- ১ এ, অন্ত্যমিল দুই মাত্রার (ত+লে=দুই মাত্রা, চ+লে= দুই মাত্রা) এবং ছড়াংশ-২ এ, অন্ত্যমিল একমাত্রার (গান=একমাত্রা,ক
ান=একমাত্রা)।
ছড়াংশ- ১ এ, দুটো মাত্রাই স্বাধীন । স্বাধীন বলতে মুক্তস্বরের (ত= একস্বর, লে=একস্বর । একেকটা স্বর একেকটা মাত্রা । একইভাবে 'চলে'র হিসেবটা হবে ।) । মুক্তস্বর বলতে যেই স্বর স্বাধীনভাবে উচ্চারণ করা যায় । যেমন- ত......, লে.....। চ.....,লে.....। এভাবে দুটো স্বরই ইচ্ছে মতো টেনে উচ্চারণ করা যায় । তাই এরা মুক্তস্বর । ছড়াংশ-২ এ, ব্যবহৃত মাত্রাটি বদ্ধ । বদ্ধ বলতে বদ্ধস্বর ( গান = একস্বর । একেকটা স্বর যেহেতু একেকটা মাত্রা সুতরাং এটি একমাত্রা । একই ভাবে 'কান' এর হিসেবটা । বদ্ধস্বর বলতে যেই স্বর উচ্চারণ করতে গেলে আটকে যেতে হয় । যেমন, গা....ন্ । কা......ন্ । এভাবে দুটো স্বরই উচ্চারণ করতে গেলে আটকে যেতে হয় । তাই এরা বদ্ধস্বর ।
আল মাহমুদের একটি পূর্ণাঙ্গ ছড়া দেখি-
নারকেলের ঐ লম্বা মাথায় হঠাৎ দেখি কাল,
ডাবের মতো চাঁদ উঠেছে ঠাণ্ডা ও গোলগাল ।
ছিটকিনিটা আস্তে খুলে পেরিয়ে গেলাম ঘর,
ঝিমধরা এই মস্ত শহর কাঁপছিল থরথর ।
মিনারটাকে দেখছি যেন দাঁড়িয়ে আছেন কেউ,
পাথরঘাটার গির্জেটা কি লাল পাথরের ঢেউ ?
দরগাতলা পার হয়ে যেই মোড় ফিরেছি বাঁয়,
কোত্থেকে এক উটকো পাহাড় ডাক দিল, আয় আয় ।
পাহাড়টাকে হাত বুলিয়ে লাল দিঘিটার পার,
এগিয়ে দেখি জোনাকিদের বসেছে দরবার ।
আমায় দেখে কলকলিয়ে দিঘির কালো জল,
বলল, এসো, আমরা সবাই না ঘুমানোর দল ।
পকেট থেকে খোলো তোমার পদ্য লেখার ভাঁজ,
রক্তজবার ঝোপের কাছে কাব্য হবে আজ ।
দিঘির কথায় উঠল হেসে ফুল পাখিরা সব,
কাব্য হবে, কাব্য হবে, জুড়ল কলরব।
কী আর করি পকেট থেকে খুলে ছড়ার বই,
পাখির কাছে, ফুলের কাছে মনের কথা কই।
ছড়াটির প্রতিটি অন্ত্যমিলই একমাত্রার । মাত্রাগুলো বদ্ধস্বরের ।
আল মাহমুদের আরেকটি ছড়া দেখি-
ছড়ার ঘরে একা আমি একলা থাকি,
গাছের শাখায় আমার নামে ডাকছে পাখি ।
পাখির কথায় আঁখির ওপর অশ্রু আনে,
আমি কি আর থাকতে পারি, পাখির গানে !
সবকিছুতে আমার আছে ছড়ার ভাষা,
গাছে গাছে উড়াল মারে আমার আশা ।
আশার মাঝে জাল বুনেছে মাকড় সা কী ?
বুকের ভেতর উঠলো ডেকে কুটুম পাখি ।
কুহুকুহু ডাকছে পাখি গাছের শাখে,
ডাক শুনে ওই থমকে দাঁড়াই পথের বাঁকে ।
বাঁক পেরিয়ে হাঁক দিয়েছে নাম ধ রে কে,
এই তো আমি অগ্রগামী, স্বপ্ন এঁকে ।
পথ যেখানে টানছে আমায় যাব কি রে,
একটু দাঁড়াই এক পা বাড়াই, দেখছি ফিরে ।
কোন কিশোরী সোনার তরী ভাসায় একা,
নামটি কি তার চোখের জলের অশ্রুলেখা?
ছড়াটির প্রতিটি অন্ত্যমিলই দুমাত্রার । মাত্রাগুলো মুক্তস্বরের ।
শামসুর রাহমানের একটি ছড়া দেখি-
ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে
রাত দুপুরে অই,
ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে
ট্রেনের বাড়ি কই?
একটু জিরোয়, ফের ছুটে যায়
মাঠ পেরুলেই বন,
পুলের ওপর বাজনা বাজে
ঝন ঝনাঝন ঝন।
দেশ বিদেশ বেড়ায় ঘুরে
নেইকো ঘোরার শেষ,
ইচ্ছে হলেই বাজায় বাঁশি,
দিন কেটে যায় বেশ।
থামবে হঠাৎ মজার গাড়ি
একটু কেশে খক,
আমায় নিয়ে ছুটবে আবার
ঝক ঝকাঝক ঝক।
ছড়াটির প্রতিটা অন্ত্যমিলই একমাত্রার । মাত্রাগুলো বদ্ধস্বরের ।
আল মাহমুদের অন্য একটি ছড়া দেখি-
ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
দুপুর বেলার অক্ত,
বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায় ?
বরকতের রক্ত।
হাজার যুগের সূর্যতাপে
জ্বলবে এমন লাল যে,
সেই লোহিতেই লাল হয়েছে
কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে !
প্রভাতফেরীর মিছিল যাবে
ছড়াও ফুলের বন্যা,
বিষাদগীতি গাইছে পথে
তিতুমীরের কন্যা।
চিনতে না কি সোনার ছেলে
ক্ষুদিরামকে চিনতে ?
রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিলো যে
মুক্ত বাতাস কিনতে ?
পাহাড়তলীর মরণ চূড়ায়
ঝাঁপ দিল যে অগ্নি,
ফেব্রুয়ারির শোকের বসন
পরলো তারই ভগ্নী।
প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী
আমায় নেবে সঙ্গে,
বাংলা আমার বচন, আমি
জন্মেছি এই বঙ্গে।
ছড়াটির প্রতিটি অন্ত্যমিলই দুমাত্রার । দুমাত্রার মধ্যে প্রথম মাত্রাটি বদ্ধস্বরের দ্বিতীয় মাত্রাটি মুক্তস্বরের ।
এখানে উদাহরণ দেওয়া সবগুলো ছড়াই অনেক জনপ্রিয় । এমন আরো জনপ্রিয় ছড়া আছে যেগুলোর সকল অন্ত্যমিলের মাত্রা একই প্যাটার্নের (তবে ব্যতিক্রমেরও অভাব নেই) । এটিই স্ট্যান্ডার্ড ।
ছড়ায় ব্যবহৃত সকল অন্ত্যমিলের মাত্রার সমতা রাখা জরুরি । এটি ছড়াকে করে তুলুন সুন্দর, সহজ, শ্রুতিমধুর

চার ।
'স্বাধীন অন্ত্যমিলের ব্যবহার'
এবার আমরা স্বাধীন অন্ত্যমিল, অর্ধস্বাধীন অন্ত্যমিল, এবং এর সঠিক প্রয়োগ সম্পর্কে জানবো ।
ছড়ায় ব্যবহৃত যে সব অন্ত্যমিল কোথাও হোঁছড় না খেয়ে সরাসরি মিলে যায় তাকেই স্বাধীন অন্ত্যমিল বলে ।
এবং ছড়ায় ব্যবহৃত যে সব অন্ত্যমিল সরাসরি মিলে না যেয়ে কোথাও হোঁছড় খায় তাদের অর্ধস্বাধীন অন্ত্যমিল বলে ।
একমাত্রায় রচিত স্বাধীন অন্ত্যমিলের উদাহরণ দিচ্ছি-
ঝক ঝকা ঝক ট্রেন চলেছে রাত দুপুরে অই,
ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে ট্রেনের বাড়ি কই ?
ছড়াংশে 'অই' শব্দটির সাথে 'কই' শব্দটি কোনরকম হোঁছড় না খেয়ে সরাসরি মিলে যায় সুতরাং এটি স্বাধীন অন্ত্যমিলের ছড়াংশ ।
একমাত্রার হোঁছড় খাওয়া অন্ত্যমিলও দেখাচ্ছি-
বিলের কোলে হাঁটুজলে থাকে পুঁটি মাছ,
পুঁটির বন্ধু ন্যাতিয়ে যাওয়া সবুজ ধোয়া ঘাস ।
ছড়াংশে 'মাছ' শব্দটির সাথে 'ঘাস' শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে । 'মাছ>ঘাস' অন্ত্যমিল পড়তে গেলে হোঁছড় খেতে হয় সুতরাং এটি অর্ধস্বাধীন অন্ত্যমিল । স্বাধীন অন্ত্যমিল হতে পারতো যদি অন্ত্যমিল এভাবে জুড়ে দেওয়া হতো, মাছ>গাছ, মাছ>নাচ, মাছ>কাঁচ, মাছ>পাঁচ ইত্যাদি ।
এবার দুমাত্রায় রচিত স্বাধীন অন্ত্যমিলের উদাহরণ দিচ্ছি-
খোকার জন্যে খুকির জন্য ‘ঘুমপাড়ানি’ ছড়া,
দাদুর জন্য মুর্শিদী গান দরদ দিয়ে গড়া ।
ছড়াংশে 'ছড়া' শব্দটির সাথে 'গড়া' শব্দটি কোন রকম হোঁছড় না খেয়ে সরাসরি মিলে যায় সুতরাং এটি স্বাধীন অন্ত্যমিলের ছড়াংশ ।
দুমাত্রায় হোঁছড় খাওয়া অন্ত্যমিলও দেখাচ্ছি-
চারিদিকে খুব আতঙ্ক জঙ্গি এলো দেশে,
ভয়ে আছে মানুষগুলো এর সমাধান কিসে !
ছড়াংশে 'দেশে' শব্দটির সাথে 'কিসে' শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে । 'দেশে>কিসে' অন্ত্যমিল পড়তে গেলে হোঁছড় খেতে হয় সুতরাং এটি অর্ধস্বাধীন অন্ত্যমিল । স্বাধীন অন্ত্যমিল হতে পারতো যদি অন্ত্যমিল এভাবে জুড়ে দেওয়া হতো, দেশে>শেষে, দেশে>এসে, দেশে> বেশে ইত্যাদি ।
এবার তিনমাত্রায় রচিত স্বাধীন অন্ত্যমিলের উদাহরণ দিচ্ছি-
মন্ত্রী বলো, এমপি বলো, কাউকে আমি চিনি না,
তাদের সুপারিশে আমি কোন টিকিট কিনি না।
ছড়াংশে 'চিনি না' শব্দটির সাথে 'কিনি না' শব্দটি কোনরকম হোঁছড় না খেয়ে সরাসরি মিলে যায় সুতরাং এটি স্বাধীন অন্ত্যমিলের ছড়াংশ ।
তিনমাত্রায় হোঁছড় খাওয়া অন্ত্যমিলও দেখাচ্ছি-
তোমার নজর ঘুষের দেহে তোমার নজর টাকাতে,
তোমায় পুলিশ ধরতে এলে বলো কোথায় লুকাতে ?
ছড়াংশে 'টাকাতে' শব্দটির সাথে 'লুকাতে' শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে । 'টাকাতে>লুকাতে' অন্ত্যমিল পড়তে গেলে হোঁছড় খেতে হয় সুতরাং এটি অর্ধস্বাধীন অন্ত্যমিল । স্বাধীন অন্ত্যমিল হতে পারতো যদি অন্ত্যমিল এভাবে জুড়ে দেওয়া হতো, টাকাতে>থাকাতে, টাকাতে>আঁকাতে, টাকাতে>ফাঁকাতে ইত্যাদি ।
এবার চারমাত্রায় রচিত স্বাধীন অন্ত্যমিলের উদাহরণ দিচ্ছি-
বাবা মানে শাসন-সোহাগ মিষ্টি রাগারাগি,
বাবা মানে সুখের মতো কষ্ট ভাগাভাগি ।
ছড়াংশে 'রাগারাগি' শব্দটির সাথে 'ভাগাভাগি' শব্দটি কোনরকম হোঁছড় না খেয়ে সরাসরি মিলে যায় সুতরাং এটি স্বাধীন অন্ত্যমিলের ছড়াংশ ।
হোঁছড় খাওয়া অন্ত্যমিলও দেখাচ্ছি-
পেছন থেকে ডেকেছিলাম মুখ বেঁকে ফিরেছিলে,
গোলাপ হাতে দিয়েছিলাম মুখের উপর ছুঁড়েছিলে ।
ছড়াংশে 'ফিরেছিলে' শব্দটির সাথে 'ছুঁড়েছিলে' শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে । 'ফিরেছিলে>ছুঁড়ে
ছিলে' অন্ত্যমিল পড়তে গেলে হোঁছড় খেতে হয় সুতরাং এটি অর্ধস্বাধীন অন্ত্যমিল । স্বাধীন অন্ত্যমিল হতে পারতো যদি অন্ত্যমিল এভাবে জুড়ে দেওয়া হতো, ফিরেছিলে>ভিড়ে ছিলে, ফিরেছিলে>ধীরে ছিলে, ফিরেছিলে>ছিঁড়েছিলে ইত্যাদি ।
স্বাধীন অন্ত্যমিল ব্যবহারে ছড়া সুশ্রী এবং শ্রুতিমধুর হয় । তালে তালে পড়া যায় ।

পাঁচ ।
'সফল অন্ত্যমিলের ব্যবহার'
এখন আমরা জানবো, কীভাবে ছড়াতে 'সফল অন্ত্যমিল' ব্যবহার করা যায়- এই সম্পর্কে ।
কিছু কথা জেনে নিই-
'অ থেকে ঔ' বর্ণগুলি স্বরবর্ণ ।
'ক থেকে চন্দ্রবিন্দু' বর্ণগুলি ব্যঞ্জনবর্ণ ।
জেনে রাখা জরুরি-
প্রতিটি ব্যঞ্জনবর্ণই স্বরবর্ণ দ্বারা গঠিত ।
যেমন- ক+অ=ক, খ+অ=খ, হ+অ=হ ।
আলোচনায় ফিরি-
'সফল অন্ত্যমিল' গঠন হয় প্রথম শব্দের আদ্যক্ষর(প্রথম অক্ষর) পরিবর্তনের মাধ্যমে ।
ছড়াংশ দিয়ে দেখাচ্ছি-
'যাদের মনে স্বপ্নগুলোর শক্তি বেশি যতো,
সফলতাও হাতছানি দেয় তাদের দিকে ততো ।'
এই ছড়াংশে অন্ত্যমিল হচ্ছে 'যতো>ততো' ।
'যতো' শব্দটিকে ভাঙলে পাই- য্+অ+ত্+ও,
'ততো' শব্দটিকে ভাঙলে পাই- ত্+অ+ত্+ও ।
উক্ত অন্ত্যমিলে শুধুমাত্র আদ্যক্ষর (প্রথম অক্ষর) পরিবর্তন হয়েছে । বাকী সব অপরিবর্তিত রয়েছে ।
একটি 'সফল অন্ত্যমিল' এভাবেই গঠিত হয় । এর বিপরীত হলে অন্ত্যমিল সফল হয় না ।
একমাত্রার 'সফল অন্ত্যমিল' এর গঠন-
'মডার্ন যুগের মডেল সে-ও নেই তুলনা তার-
কী যে মধুর কথাবার্তা, আচার-ব্যবহার ।'
এই ছড়াংশে একমাত্রার অন্ত্যমিল হচ্ছে 'তার<হার' । 'তার' শব্দটিকে ভাঙলে পাই- ত্+আ+র্, 'হার' শব্দটিকে ভাঙলে পাই- হ্+আ+র্ । উক্ত অন্ত্যমিলে শুধুমাত্র আদ্যক্ষর (প্রথম অক্ষর) পরিবর্তন হয়েছে । বাকী সব অপরিবর্তিত রয়েছে । সুতরাং এটি একমাত্রার 'সফল অন্ত্যমিল' । একমাত্রার 'ব্যর্থ অন্ত্যমিল' এর গঠন- 'মডার্নযুগের মডেল সে-ও নেই তুলনা তার- পদে বসে চুরি করে নাম করা সে চোর ।' এই ছড়াংশে একমাত্রার অন্ত্যমিল হচ্ছে 'তার<চোর' । 'তার' শব্দটিকে ভাঙলে পাই- ত্+আ+র্, 'চোর' শব্দটিকে ভাঙলে পাই- চ্+ও+র্ । উক্ত অন্ত্যমিলে শুধুমাত্র আদ্যক্ষরই (প্রথম অক্ষর) পরিবর্তন হয়নি । পরিবর্তন হয়েছে মধ্যাক্ষরও । সুতরাং এটি একমাত্রার 'ব্যর্থ অন্ত্যমিল' । দুমাত্রার 'সফল অন্ত্যমিল' এর গঠন- 'বটতলাতে পাতার ফাঁকে দুষ্টরোদের খেলা, পশ্চিমে এক ছোট্ট গাঁয়ে ফুল-প্রজাদের মেলা ।' এই ছড়াংশে দুমাত্রার অন্ত্যমিল হচ্ছে 'খেলা<মেলা' । 'খেলা' শব্দটিকে ভাঙলে পাই- খ্+এ+ল্+আ, ' মেলা' শব্দটিকে ভাঙলে পাই- ম্+এ+ল্+আ । উক্ত অন্ত্যমিলে শুধুমাত্র আদ্যক্ষর (প্রথম অক্ষর) পরিবর্তন হয়েছে । বাকী সব অপরিবর্তিত রয়েছে । সুতরাং এটি দুমাত্রার 'সফল অন্ত্যমিল' । দুমাত্রার 'ব্যর্থ অন্ত্যমিল' এর গঠন- 'বটতলাতে পাতার ফাঁকে দুষ্টরোদের খেলা, দেখতে পাই না এসব আমি মন-দরোজায় তালা ।' এই ছড়াংশে দুমাত্রার অন্ত্যমিল হচ্ছে 'খেলা<তালা' । 'খেলা' শব্দটিকে ভাঙলে পাই- খ্+এ+ল্+আ, 'তালা' শব্দটিকে ভাঙলে পাই- ত্+আ+ল্+আ । উক্ত অন্ত্যমিলে শুধুমাত্র আদ্যক্ষরই (প্রথম অক্ষর) পরিবর্তন হয়নি । পরিবর্তন হয়েছে মধ্যাক্ষরও । সুতরাং এটি দুমাত্রার 'ব্যর্থ অন্ত্যমিল' । তিনমাত্রার 'সফল অন্ত্যমিল' এর গঠন- 'ছোট্ট ছেলে দুষ্ট ছেলে দস্যি ছেলে রাতুলে, এদিক ওদিক ছুটে বেড়ায় মাটির বুকে পা তুলে ।' এই ছড়াংশে তিনমাত্রার অন্ত্যমিল হচ্ছে 'রাতুলে<পা তুলে' । 'রাতুলে' শব্দটিকে ভাঙলে পাই- র্+আ+ত্+উ+ল্+এ, 'পা তুলে' শব্দটিকে ভাঙলে পাই- প্+আ+ত্+উ+ল্+এ । উক্ত অন্ত্যমিলে শুধুমাত্র আদ্যক্ষর (প্রথম অক্ষর) পরিবর্তন হয়েছে । বাকী সব অপরিবর্তিত রয়েছে । সুতরাং এটি তিনমাত্রার 'সফল অন্ত্যমিল' । তিনমাত্রার 'ব্যর্থ অন্ত্যমিল' এর গঠন- 'ছোট্ট ছেলে দুষ্ট ছেলে দস্যি ছেলে রাতুলে, ভাইকে সেদিন রেগে বললো মুখে খাবার দে তুলে । ' এই ছড়াংশে তিনমাত্রার অন্ত্যমিল হচ্ছে 'রাতুলে>দে তুলে ।
'রাতুলে' শব্দটিকে ভাঙলে পাই- র্+আ+ত্+উ+ল্+এ,
'দে তুলে' শব্দটিকে ভাঙলে পাই- দ্+এ+ত্+উ+ল্+এ ।
উক্ত অন্ত্যমিলে শুধুমাত্র আদ্যক্ষরই (প্রথম অক্ষর) পরিবর্তন হয়নি । পরিবর্তন হয়েছে মধ্যাক্ষরও । সুতরাং এটি তিনমাত্রার 'ব্যর্থ অন্ত্যমিল' ।
চারমাত্রার 'সফল অন্ত্যমিল' এর গঠন-
'ফাতেমার বর ফাতেমারে,
দিনে মারে রাতে মারে ।'
এই ছড়াংশে চারমাত্রার অন্ত্যমিল হচ্ছে 'ফাতেমারে<রাতে মারে' ।
'ফাতেমারে' শব্দটিকে ভাঙলে পাই- ফ্+আ+ত্+এ+ম্+আ+র্+এ,
'রাতে মারে' শব্দটিকে ভাঙলে পাই- র্+আ+ত্+এ+ম্+আ+র্+এ ।
উক্ত অন্ত্যমিলে শুধুমাত্র আদ্যক্ষর (প্রথম অক্ষর) পরিবর্তন হয়েছে । বাকী সব অপরিবর্তিত রয়েছেছড়ামর্শ
★ ছয় ।
'ছড়ায় ব্যবহৃত শব্দের বাহুল্য দোষ এবং কিছু অপ্রয়োজনীয় শব্দ এভয়েড'
সরাসরি আলোচনায় ফিরি-
তরুণ ছড়াকার সৈয়দ শরীফ-এর একটি ছড়াংশ দেখি-
এখন যে আর পাখিরা সব- আগের মতো ডাকে না,
সবাই তারা একলা ওড়ে, আগের মতো ঝাঁকে না ।
নিজের মতো নিজে বাঁচে, কাউকে মনে রাখে না,
এক গাছেতে সবাই মিলে কেউ যে তারা থাকে না ।
ছড়াংশটি বিশ্লেষণ করি-
প্রথম বাক্যে 'পাখিরা সব' কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে । যেখানে বাহুল্য দোষ প্রকাশ পায় । 'পাখিরা' শব্দটি বহুবচন , 'সব' শব্দটিও বহুবচন । একইভাবে দ্বিতীয় বাক্যে 'সবাই তারা' দুটি বহুবচন শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে । দুটি বহুবচন শব্দ একসাথে ব্যবহার করাই বাহুল্য দোষ । যা করা মোটেও ঠিক নয় । একটি বহুবচন শব্দ ব্যবহার করাই শ্রেয় । মনের অজান্তে এই ভুলটা অনেকেই করি । ভুল করা দোষের কিছু না । তবে জেনেও শুধরে না নেওয়াটাই দোষের । কেননা এমন ভুলতো কবি আল মাহমুদও করেছিলেন ।
আচ্ছা কবি আল মাহমুদের একটি ছড়া বিশ্লেষণ করে সেটাও দেখাচ্ছি-
অঙ্ক নিয়ে বসলে আমার কখন কী যে হয়,
টেবিলটাও পর হয়ে যায় বইগুলো সব ভয় ।
ভয়ের চোটে ভাবতে থাকি শহর ভেঙে কেউ,
দালান কোঠা বিছিয়ে দিয়ে তোলে খেতের ঢেউ ।
রাস্তাগুলো নদী এবং গলিরা সব খাল,
ইলেকট্রিকের খাম্বাগুলো পাল্টে হলো তাল ।
মোটরগাড়ি গরুর পালে হাম্বা তুলে হাঁটে,
পুলিশগুলো গুলিস্তানে নিড়ানি ঘাস কাটে ।
আব্বা হলেন কাকতা ড়ুয়া আম্মা হলুদ পাখি,
বুবুরা সব ভুঁইকুমড়ো পাতায় ঢেকে রাখিব ।
সবাই যখন পাল্টে গেছে নিজের ঘরে নাই,
আমিই তখন ইচ্ছে মতন খোকন হয়ে যাই ।
কেউ বলে না আঁক কষতে কেউ বলে না লেখ্,
কেউ ধরে না কানের লতি, কেউ বলে না শেখ্ ।
ঢাকা শহর, ঢাকা শহর সবুজ হয়ে যাও,
কলেজগুলো সর্ষে বাগান ভার্সিটিতে লাউ ।
উক্ত ছড়ায় ব্যবহৃত 'গলিরা সব', 'বইগুলো সব', 'বুবুরা সব' শব্দগুলোতে বাহুল্য দোষ বিদ্যমান ।
ফিরে আসি সৈয়দ শরীফ-এর ছড়াংশে ।
ছড়াংশের শেষের লাইনটি দেখি-
'এক গাছেতে সবাই মিলে কেউ যে আর থাকে না '
লাইনটির ছন্দ কাঠামো ঠিক রাখার জন্যে অযথাই 'তে', 'যে' সংযোগ করা হয়েছে । এতে করে ছড়ার সৌন্দর্য কমে গেছে । আমরা- যারা তরুণ, ছড়া লিখতে চেষ্টা করি, প্রায় অনেকেই এই ভুলটা করি । অনেকে আবার ছন্দ কাঠামো ঠিক রাখার জন্যে 'ভাই' শব্দটাও জুড়ে দেয় । অথচ এসব পরিহার করেও ছড়া দাঁড় করানো যায় । বিজ্ঞ ছড়াকাররা তাই-ই করেন ।
নাসের মাহমুদের একটি ছড়ার মাধ্যমে তাও দেখাচ্ছি-
কেমন আছ গড়াই নদী, জলের ঝিকিমিকি,
মটরলতা, বাঁশের পাতা, আরশোলা, টিকটিকি ।
কেমন আছ খেলার সাথী সেই রাখালের দল,
ঝরাপাতা, রায়বাবুদের দীঘির কালো জল ।
কেমন আছ ধানকণ্যে, গম কাউনের মেয়ে,
দুধের গাভী, পুঁইয়ের মাচা, খেয়া নৌকার নেয়ে ।
কেমন আছ গংগাফড়িং, পথের ধূলো আর,
লাল পিঁপড়ে, ঘাসের চারা, চিকন খালের পাড় ।
কেমন আছ বেতস, নাটা, বুনো গাছের বড়ুই,
উইয়ের ঢিবি, ঘুঘুর বাসা শালিক, বাবুই, চঁড়ুই ।
কেমন আছ কলমিলতা, বাবলা ফুলের রং,
গাঁয়ের আকাশ, গাঁয়ের বাতাস, চলার বলার ঢং ।
কেমন আছ মাঠের ঢেলা, শুকনো গাঙের চর,
রসের পিঠে, গুড়ের পায়েশ, ঘন দুধের সর ।
কেমন আছ বকের ব্যাটা, নীল মোরগের ঝুঁটি,
বিল-বাওরে রেলের খাদে ডানকানা, বাইন, পুঁটি ।
কেমন আছ চিতল, কাতুল শিংগী, মাগুর মাছ,
আড়ং-মেলা, গাঁয়ের হাটে বুড়ো বটের গাছ ।
কেমন আছ তিল-তিশী আর চিড়ে মুড়ি খই,
মাখন মাঠা ঘি ও ছানা গোয়ালাদের দই ।
কেমন আছ তুলসী, তমাল, গরুর গাড়ির চাকা,
কাঁসার বাটি যবের ছাতু দুধে গুড়ে মাখা ।
কেমন আছ তালের আঁটি তার ভিতরে ফোঁপড়া,
লাটাই ঘুড়ি, ছিপ বড়শী, মাছ ধরবার টোপরা ।
কেমন আছ লাঠি খেলা হা-ডুডু ডাংগুলি,
বাউল বাঁশি, পুঁথিপাঠক, ঢোলবাদক ও ঢুলি ।
কেমন আছ জোনাক ঝিঁঝিঁ, লক্ষ্মীপেঁচার ডাক,
মাঠের পাড়ে দত্তবাড়ী-বাগানে মৌচাক ।
কেমন আছ গাবের বিচি, ডাব-সুপারির বন,
হাটে মাঠে ঘাটে চলা গাঁয়ের মানুষজন ।
কেমন আছ কেয়া কদম, শিমুল পলাশ ফুল,
প্রথম পড়ার পাঠশালাটি, বেঞ্চি, টেবিল টুল ।
কেমন আছ ষড়ঋতু ছয় রকমের রূপ,
দিনের সকল কোলাহল আর রাতের যত চুপ ।
কেমন আছিস মামণি তুই- আগের মতোই নাকি ?
সবাই অনেক ভালো থাকিস, আজকে চিঠি রাখি ।
ছড়াটিতে 'তে', 'যে', 'ভাই' এসব ব্যবহার করা হয়নি ( যদিও ছড়াটির অন্ত্যমিলগুলোর মাত্রাসমতা ছিল না) । অযথাই এসব ব্যবহার না করাই একটি সফল ছড়ার গুণ । জনপ্রিয় ছড়াগুলোও কিন্তু এসব পরিহার করা । একটু খোঁজ নিয়ে দেখলেই তা বুঝতে পারবেন ।
ভালো ছড়া দাঁড় করাতে হলে 'বাহুল্য দোষ', 'তে', 'যে', 'ভাই' শব্দগুলো এভয়েড করতে হবে । এগুলো ছড়ার মেদ বাড়ায়, ভুঁড়ি বাড়ায়, সৌন্দর্য নয় ।
সাত ।
'ছড়ায় পাঞ্চ ব্যবহার'
ছড়ার শরীর দেখতে সহজ-সরল-ঝরঝরে মনে হলেও আক্ষরিক অর্থে ছড়া অনেক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হয়ে থাকে । ছড়াকে মজার করে তুলতে হলে পাঞ্চ দিতেই হবে । এখন আমরা পাঞ্চ নিয়ে কথা বলবো ।
আমরা অনেকেই পাঞ্চ শব্দটির সাথে পরিচিত । পাঞ্চ শব্দটি সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত হয় জোক(কৌতুক) এর সাথে । কৌতুকের পাঞ্চ যেমন শেষে থাকে, ছড়ার পাঞ্চও ঠিক শেষেই (শেষ লাইনে) থাকে । পাঞ্চ হচ্ছে উত্তেজনা । এই উত্তেজনা হতে পারে মজার, খোঁচার, সাংঘর্ষিক, অসঙ্গতির, প্রতিবাদের, ব্যাঙ্গাত্মক ।
ছড়াতে যে যতো ভালো পাঞ্চ দিতে পারে তার ছড়া ততবেশী ক্রিয়েটিভ হয় । পাঠক সেটি পড়ে আন্দোলিত বোধ করে ।
আখতারুজ্জামান আজাদ এর পাঞ্চঅলা একটি ছড়া পড়ে আসি-
আপনি যুগের শ্রেষ্ঠ কবি; ক্যামনে পারেন, গুরু ?
চক্ষে আসে অশ্রু আমার, বক্ষে দুরু-দুরু ।
আপনি হলেন আটাশ কেবল, তাতেই এত যশ;
লেখা তো নয়, মাখন পুরো, শীতের খেজুর-রস !
দু-হাত ভরে লেখেন কত, করেন কত কাজ;
আপনি আছেন বলেই লোকে স্বপন দ্যাখে আজ ।
আমি কি আর ভক্ত একা, ভক্ত ঘরের সবে;
আব্বা পড়েন সমস্ত দিন 'শুদ্ধ হব, হবে ?'
মা আমাকে শুধোয় সেদিন— ঐ ছেলেটা কে রে ?
এত্ত সাহস পায় সে কোথা, ক্যামনে ওঠে পেরে ?
বান্ধবীরা সবাই বলে— আপনি লেখেন কড়া,
পড়ার পরে বেহুঁশ সবাই ইয়াম্মিদের ছড়া ।
ময়না আমার কয় না কথা, বায়না ধরে শত—
পারলে দুটো পদ্য লেখো অমুক কবির মতো !
আমার সাধের প্রেমটা যদি ভেঙেই কভু যায়;
জানি না তো কিচ্ছু, কবি, আপনি নেবেন দায় ।
মহান কবি, যুগের রবি, স্যালুট দিলাম খাড়া;
ঐ দু-হাতে যাহাই লেখেন, তাহাই হৃদয়-কাড়া ।
কোন দু-হাতে লেখেন যে, ভাই, দেখব আমি ছুঁয়ে;
ইচ্ছে করে— পান করি জল চরণ দুটি ধুয়ে !
মেলায় গিয়ে সেলফি নেব, করব কদমবুচি;
পোশাক দেখে বলতে হবে— আপনার আছে রুচি ।
লজ্জা ভেঙে একটা কথা বলেই দেবো নাকি ?
ছোট্ট থেকে আমিও, গুরু, লিখছি টুকিটাকি ।
নেক নজরে একটু যদি তাকান আমার দিকে;
আমিও হব ছোট্ট কবি, ছিঁড়বে আমার শিঁকে ।
আপনি হলেন লিভিং লিজেন্ড, আপনি আমার ভাই;
শিষ্য করে নেবেন আমায় ? লিস্টে দেবেন ঠাঁই ?
এ কী, ও ভাই, চিকু ?
আপনি দেখি ডিলিট দিলেন আমার সাধের রিকু !
বাসায় যদি আয়না থাকে, দেখিস খোমা নিজে;
আড়াইখানা পদ্য লিখে ভাবিস, শালা, কী যে !
আমার কাছে আসিস, ব্যাটা, শিখিয়ে দেবো তোকে;
গদ্য লেখে, পদ্য লেখে কেমন করে লোকে ।
ছেড়েই দিলাম আজকে তোকে, আদায় করিস শুকুর;
রাস্তাঘাটে মারব তোকে, য্যামনে মারে কুকুর !
দুই পকেটে দশটা কবি আমার আছে তোলা;
করব না আজ মুখটা খারাপ, **মারানির পোলা !
ছড়াটির শেষে একটা উত্তেজনা আছে । এই উত্তেজনাটা মজার, কৌতুকীয়, হাসির । ছড়াকার খুব বুদ্ধিদীপ্তের সাথে এখানে পাঞ্চটি ব্যবহার করেন । এটি পড়ে যে কেউই আন্দোলিত হবে ।
ছড়াকার Sa'ad Sharif এর একটি ছড়া পড়ে আসি-
হৃষ্ট পুষ্ট ছিলেন আগে আমার শ্যামল মাতা
লাল গড়নের ঐ শাড়ীতে বেশ মানাতো তাঁকে
যারা ছিলেন সহায়-স্বজন কিংবা মাথার ছাতা
ঠিক তাদেরই নির্যাতনে বেগ পেতে হয় মাকে ।
আমার দাদী কিংবা চাচার বৈরী আচরণে
অত্যাচারে দেহটি তাঁর রঞ্জীত হয় লালে
পর্তুগীজ আর ফরাসীদের যাওয়ার পরক্ষণে
চলতে থাকে ইংরেজীদের উপনিবেশকালে ।
কিন্তু চাচা - দাদীর সাথেই বৈরী হলেন বাবা
এমন ব্যাপার মা-জননী কেমন করে ভাবে !
সাতচল্লিশে পৃথক হলো এ সংসারের কাবা
মা ভেবেছেন এবার বুঝি গুছিয়ে নেওয়া যাবে।
কিন্তু আবার একাত্তরে তাঁরচে কয়েকগুণে
বক্ষটা তাঁর ঝাঁঝরা হলো তপ্ত মেশিনগানে
ওরাতো খুব পারদর্শী ধর্ষন এবং খুনে
এ কোন জাতের ভাই সহদোর আল্লা- মাবুদ জানে ।
নেই চুলোতে আগুন এখন নেই হাঁড়িতে চাল,
আর কতকাল চেয়ে চেয়ে হাত পেতে মা খাবে?
একাত্তর আর সাতচল্লিশ ক্রয়ের দু,টি কাল
দুই শাড়িতে আমার মায়ের আর কতদিন যাবে ?
ফ্রেম আছে তাঁর হাড়ের শুধু মাংসতো নেই গায়
নেই পরনে কাপড় মায়ের শরম দেখে সবে
এমন হলে সম্ভ্রম তাঁর থাকে কি আর হায় !
নগ্ন দেহে বেঁচে থাকা যায় নাকি এই ভবে ?
পেট ভরে ভাত চাইনে আমি ,ঘাস চিবিয়ে নাও
ঘাস চিবিয়ে মায়ের মুখে দু,ফোটা রস দাও
লালগড়নের সেই শাড়িটা নেই প্রয়োজন তাও
ছেড়া কাঁথায় জননীকে দাও না ঢেঁকে দাও ।
এই ছড়াটির পাঞ্চ লাইনে ছড়াকার খুব বুদ্ধির সাথে সমাজের করুণ অসঙ্গতি তুলে ধরেছেন । যা পড়ার পর পাঠক এক ধরণের করুণরস উপলব্দি করবে ।
পাঞ্চ যে শুধু বড়তোষ ছড়াতে ব্যবহার হয় তা কিন্তু না । বাচ্চাতোষ ছড়াতেও পাঞ্চ থাকতে পারে ।
ছড়াকার জিসান মেহবুব এর একটা ছড়া পড়ে আসি-
টিপ টিপ টিপ বৃষ্টি ঝরে
যায় গড়িয়ে দুপুর,
পায় যেন তার রুনুঝুনু
বেজে ওঠে নূপুর ।
নূপুর বাজে বৃষ্টিমেয়ের
দৃষ্টি কাড়ে পুকুর,
এমন দিনে ঠিক হয়েছে
পুতুলবিয়ে খুকুর ।
খুকুর মনে খুশির ঝিলিক
ক্লিক মেরেছে তুতুল,
বর এসেছে বৃষ্টি ভিজে
কাঁদছে শুনে পুতুল ।
এই ছড়াটিতে ছড়াকার খুবই সরলতার সাথে পাঞ্চ ব্যবহার করেছেন । যা পড়লে শিশুদের মনোরঞ্জনতো হবেই । বড়দেরও হবে ।
লিমেরিক লিখতে হলে পাঞ্চ দিতেই হবে । শেষ লাইনে পাঞ্চ ছাড়া লিমেরিক হয় না । সেটি বড়জোর পঞ্চপদী হতে পারে ।
ছড়াকার মিজানুর রহমান শামীম এর একটি লিমেরিক পড়ে আসি-
দাদুর কত বুকের পাটা পারিনিকো চিনতে কাল,
শখ করে খুব হাটে গেলেন তরতাজা মাছ কিনতে কাল,
পুঁটি মাছের দাম শুনে
আল্লা খোদার নাম গুনে
ইলিশ মাছের দাম শুনতেই হার্ট এটাকে ইন্তেকাল ।
ছড়াটির পাঞ্চ লাইনে ব্যাঙ্গাত্মকভাবে সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরা হয়েছে । যা পড়ে যে কেউই বিনোদিত হবে ।
আর কত অন্য ছড়াকারদের ছড়া উদাহরণ দিব ? এবার আমার লেখা একটি ছড়া পড়ে আসি-
বিনা ভোটে পাশ হয়েছে এমপি সুরত আলী খাঁ-য়,
মিষ্টিরসে মুখ ভিজে তার চ্যালাপ্যালা বালি খায় ।
দুলাভাইয়ের দাপট নিয়ে চলে শালা-শালিকায়,
অবাধ মেলামেশা করে তারই ছোট বালিকায় ।
লোকটা যে ভাই মস্ত পেটুক ইচ্ছেমতো খালি খায়,
নিজ কথাকে ডিম বানিয়ে দৈনিক ডিমের হালি খায় ।
সুযোগ পেয়ে বাজেট মেরে উন্নয়নের নালী খায়,
নালীটাকে কয়লা করে অবশেষে ছালি খায় ।
ছালি শুধু ? চেটেচুটে পড়ে থাকা কালি খায়,
বছর শেষে নাম আসে তার সেরা ধনীর তালিকায় ।
নিজের সু-নাম করে বেড়ায় পত্রিকাতেও তা লিখায়,
দুর্নীতিকে না বলে সে , ধুর! নীতির ফালি খায় ।
পথে-মাঠে মহাসভায় জনস্রোতের তালি খায়,
মানুষজনের আড়াল হলেই বিশ্রী নোংরা গালি খায় ।
অন্ধকারে শত্রুদলের রক্তভরা ডালি খায়,
জনগণকে ভেড়া ভেবে আস্ত ভেড়ার পালই খায় ।
খাওয়া শেষে আয়েশ করে বোতল পানি লালই খায়,
মাঝে মাঝে শখের বশে একটু আধটু ডালই খায় ।
ভয়ের চোটে গভীর ঘুমে দফায় দফায় ফালই খায়,
এসব কি আর নতুন কিছু ? খাচ্ছে , চিরকালই খায় ।
ছড়াটির পাঞ্চ লাইনে সমাজের খাদক নেতাদের খোঁচা দেওয়া হয়েছে ।
পাঞ্চ বলতে অনেকে খোঁচা মনে করেন । আর এই খোঁচা নিয়ে কথা বলতে গেলে আমি ছড়াকার জগলুল হায়দারের মূল্যবান কথাগুলোই বলবো-
'খোঁচা একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ কিন্তু তা প্রায়ই আঘাতমূলক না হয়া বরং আনন্দমূলক হয় । অনেকটা আমগো বর্ষশেষের টাইটেল বা খেতাবের মতো । ব্যাঙ্গ কইরা দেয়া হইলেও যারে দেয়া হয় এমুনকি সেও মজা পায় । আর এরম মজা তৈরির জন্য দরকার শাণিত 'উইট' । উইট কিন্তু ভাঁড়ামি নয় । এইটা অনেকটা তীব্র বুদ্ধিদীপ্ত কৌতুক । আর এর লগে আবার 'হিউমার' বা রসবোধ মিশা থাকে ।'
ছড়াকে আকর্ষণীয় রসাত্মক করে তুলতে হলে বুদ্ধিদীপ্ত পাঞ্চ ব্যবহার করতেই হবে ।আট ।
'ছড়া সাক্ষাৎকার নেওয়ার কৌশল'
'ছড়ামর্শ-সাত' পর্যন্ত আমরা ছড়ার জন্ম, সুস্থ শরীর, হাঁটা-চলা কীভাবে করাতে হয় তা জেনেছি । এবার ছড়ার রূপ-লাবণ্য সম্পর্কে জানবো ।
ছড়া নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা বিভিন্নভাবে ছড়াকে উপস্থাপন করেছে বিভিন্নরকম স্টাইলে । কেউ গল্পকে উপস্থাপন করেছে ছড়ারূপে, কেউ উপন্যাসকে উপস্থাপন করেছে ছড়ারূপে, কেউ কেউ আবার ছড়ারূপে উপস্থাপন করেছেন সাক্ষাৎকারকেও । অক্লান্ত এই প্রচেষ্টায় ছড়া হয়ে উঠেছে বৈচিত্র্যময় ।
এখন কথা বলবো ছড়া সাক্ষাৎকার নিয়ে ।
মূলত, এই ধরণের সাক্ষাৎকারগুলো হয়ে থাকে ছড়াকারের সাথে ছড়াকারের ।
সাক্ষাৎকারের সৌন্দর্য হচ্ছে-
যিনি সাক্ষাৎ নিবেন (প্রশ্নকর্তা), তিনি অল্প কথায় যতবেশি পারেন প্রশ্ন করবেন । আর যিনি সাক্ষাৎ দিবেন (উত্তরদাতা), তিনি যতবেশি পারেন বিস্তারিত উত্তর দিবেন । কিন্তু আজকাল আমরা এর উল্টোটা ঘটতে দেখি ।
এক নজরে কয়েকটি ছড়া সাক্ষাৎকারের অংশ পড়ে আসি-
এক।
কাব্য :
কোন অঞ্চলে শৈশব কাটে কোথায় লেখাপড়া,
এবং কোথায় ছাপা হলো প্রথম লেখা ছড়া ?
জগলুল হায়দার :
জন্মের আগেই ঢাকা আমার পরে জামালপুরে,
নরসিংদী গাজীপুরেও দিন কেটেছে ঘুরে ।
লেখাপড়া এসব জাগায় নানান ধাপে ধাপে,
এই পৃথিবী পাঠশালা তাই বলেছিলেন বাপে ।
প্রথম লেখা ছিয়াশিতে ম্যাগাজিনে ছাপা,
ছেপেছিলো ছোটবোনে মারছি না ভাই চাপা ।
দুই।
কাব্য :
নতুন বছর, প্ল্যানিং কেমন ? কী করেছেন পণ ?
দেখাশোনা হচ্ছে এখন কয়টা সংগঠন ?
আপন অপু :
দিনের চিন্তা দিনে করি নতুন প্ল্যানিং নেই,
শিশু-কিশোর ভূবন গড়া স্বপ্নটা যে এই ।
চন্দ্রগঞ্জ প্রেসক্লাব আর সেভ দ্যা ফিউচার,
এলাকার এক স্কুলেও ছিলাম কদিন স্যার ।
তিন।
কাব্য :
কী অবস্থা ? ঝেড়ে বসুন । করবো প্রশ্ন কড়া,
মন দিয়েছেন উপন্যাসে কোথায় গেল ছড়া ?
আরকানুল ইসলাম :
আল্লাহ’র কাছে শোকরিয়া খুব, রেখেছে তো বেশ,
ঝেড়ে বসে তোমার কথার করছি জবাব পেশ ।
ছড়ার জা’গায় ছড়া আছে, উপন্যাসে মন-
কেন দিলাম বলছি শোনো- তুমি নাও আসন !
ছড়ালেখক অনেক আছে, উপন্যাসে কম,
জানাতে চাই উপন্যাসের ধরায় স্বাগতম ।
এই জা’গাটা খালি আছে, তাই ধরেছি হাল
শিশু-কিশোর মনন-নাওয়ে ওড়াতে চাই পাল ।
শুনলে হয়তো অবাক হবে, লাগাও চোখে লেন্স !
ছড়া আমার শিরায়-শিরায়, ছড়া সেভেন্থ সেন্স ।
চার।
কাব্য :
কেমন আছেন, কোথায় আছেন, কোন খেয়ালে তবে !
কী ছিলই বা প্রথম লেখা ছাপা হলো কবে ?
শাহাদাৎ শাহেদ :
ভালো আছি । রাজধানীর এই অলি-গলিপথে,
ব্যস্ত সবাই ব্যস্ত আমি। কাটছে কোনো মতে ।
নৈতিক অধপতন জালে ডুবে আছে সবে,
কেমনে বলো অনেক বেশি ভালো থাকি তবে !
অসঙ্গতি, অন্যায় এবং জীর্ণ ঝরা নিয়ে,
লিখবো বলে কলম ধরা, করছি তা মন দিয়ে ।
ছড়া দিয়েই যাত্রা শুরু, প্রথম প্রকাশ ছড়া,
কোনোটিতে আবেগ ভরা কোনোটি ঝাল কড়া ।
প্রথম লেখা ছড়া ছিলো। ছড়ার বড়া ভাই,
ছাপা হবার অনন্দ আহ! ভাবলেই মজা পাই ।
পনেরো সাল, জানুয়ারি, তারিখ ছিলো তিন,
বাংলাদেশ সময়ে প্রথম লেখা ছাপার দিন ।
পাঁচ।
কাব্য :
করবো না আর প্রশ্ন কোনো এই প্রশ্নটির শেষে,
লেখায় কাকে গুরু মানেন বলুন কেন, কে সে ?
শামীম খান যুবরাজ :
কাকে রেখে কাকে বলি সবার কাছেই শিখি,
আল মাহমুদ প্রিয় আমার তাঁর প্রেরণায় লিখি ।
উক্ত ছড়া সাক্ষাৎকারগুলোর বৈশিষ্ট্য-
১ । প্রশ্নকর্তার একটি কথার মধ্যে তিন-চারটি প্রশ্ন ।
২ । উত্তরদাতার বিস্তারিত উত্তর প্রদান ।
৩ । প্রশ্নদাতার প্রশ্ন এবং উত্তরদাতার উত্তরও একই ছন্দকাঠামোয় রচিত ।
আরো দুটি ছড়া সাক্ষাৎকারের অংশ দেখি-
সৈয়দ শরীফ :
প্রবাস-জীবন জানা হলো এবার অন্য প্রসঙ্গে,
অনেক প্রশ্ন জমা আছে আমার বুকের তরঙ্গে ।
লেখালেখি চলছে কেমন ? পত্রিকা আর নেটে,
কলম দিয়েই লিখেন নাকি- কম্পিউটার- সেটে ?
লুতফর রহমান :
কম্পুটার কাড়ছে হাতের লেখাও,
নেটের মাঝে হচ্ছে রোজ শেখাও ।
এই সাক্ষাৎকারটিতে দেখা যায় প্রশ্নকর্তার প্রশ্নটি বিস্তারিত । উত্তরদাতার উত্তর প্রশ্নের চেয়েও সংক্ষিপ্ত । যা মোটেই কাম্য নয় । কারণ আবারো বলছি সাক্ষাৎকারের সৌন্দর্য হচ্ছে, যিনি সাক্ষাৎ নিবেন (প্রশ্নকর্তা), তিনি অল্প কথায় যতবেশি পারেন প্রশ্ন করবেন । আর যিনি সাক্ষাৎ দিবেন (উত্তরদাতা), তিনি যতবেশি পারেন বিস্তারিত উত্তর দিবেন ।
এছাড়াও অনেকে ছড়া সাক্ষাৎকারের ছন্দকাঠামোকে ভেঙেও ছড়া সাক্ষাৎকার করে থাকেন । সেটিও অন্যরকম সৌন্দর্য বহন করে ।
ছড়া সাক্ষাৎকারে অল্প কথায় প্রশ্ন এবং প্রশ্নের কম্পলিট উত্তর থাকতে হবে ।
নয় ।
'নিয়ম মেনে ছড়ার নিয়ম ভাঙ্গা'
এতক্ষণ এই সিরিজে ছড়া লেখার নিয়মকানুন আলোচনা করা হয়েছিল । নিয়ম মেনে লেখার কথা শুনতে শুনতে অথবা লিখতে লিখতে সবাই বোরিং হয়ে গেছে । তাই বোরিংনেস কাটাতে এখন কথা বলবো নিয়মভাঙ্গা নিয়ে ।
নিয়মগুলো আমার, আপনার মতো মানুষদেরই তৈরি । সুতরাং এসব নিয়মকানুন আমি, আপনি ভাঙ্গতেই পারি । তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে- নিয়ম ভাঙ্গার অধিকার তারই আছে, যে নিয়ম জানে । সুতরাং নিয়ম ভাঙ্গতে হলে সর্বপ্রথম নিয়ম জানতে হবে ।
অনেকেই বলেন, 'ছড়া হচ্ছে গড গিফটেড । নিয়ম মেনে লিখতে হবে কেন ?' তাদেরকে আমি বলবো- প্রতিভা হচ্ছে গড গিফটেড, ছড়া নয় । আর ঐ প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে ছড়া লেখার চেষ্টা করতে হয় । ধরুন, আপনি জন্ম থেকেই প্রতিভা নিয়ে এসেছেন । সেটাকে কাজে লাগিয়ে ডাক্তারি পড়ছেন । এক পর্যায়ে ডাক্তার হয়ে গেলেন । তাহলে কী আমি বলতে পারবো আপনার ডাক্তার হয়ে যাওয়াটা গড গিফটেড । মোটেই না । কারণ আপনার প্রতিভাটা যদি ডাক্তারিতে না লাগিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিংএ লাগাতেন তাহলে আপনি ইঞ্জিনিয়ারই হতেন, ডাক্তার নয় । ছড়ার ব্যাপারটাও এই রকম । অনেকে ভালো আঁকতে পারেন, ছড়া লিখতে পারেন না । কারণ তিনি তার প্রতিভাকে আঁকাআঁকির কাজে লাগিয়েছেন । কেউই জন্ম থেকে ছড়াকার, শিল্পী হয়ে আসেন না। আস্তে আস্তে চেষ্টা এবং আগ্রহের ফলে ছড়াকার, শিল্পী হয়ে ওঠেন । তবে হ্যাঁ আমি অবশ্যই বিশ্বাস করি সমগ্র বিশ্বে যা কিছু হয় বা ঘটে সবকিছু মহান আল্লাহ্ তা'লার ইচ্ছার ফলেই ।
অনেকেই নিয়মভাঙ্গা বলতে নিয়ম না মানাকে বোঝেন । ব্যাপারটা কিন্তু তা নয় । নিয়ম মেনেই নিয়ম ভাঙ্গতে হয় । ভাবছেন সেটা আবার কেমন ? ধৈর্য ধরুন, উদাহরণ দিয়ে বুঝাচ্ছি ।
নিয়ম না জানা এক আনাড়ি লেখকের নিয়মভাঙ্গা একটা ছড়া দেখে আসি-
লকার ছাড়া ভল্ট আমার পকেট ছাড়া প্যান্ট
দিন আছে তাই রাত চলে যায়,
খোয়াব পুরের গাঁয় ।
ঘর ছাড়া বাড়ি আমার টায়ার ছাড়া গাড়ী
রানী ছাড়া রাজা হব কেমনে তাড়াতাড়ি ?
উপরের ছড়াটি পড়তে কেমন লেগেছে ? নিশ্চয়ই পড়তে যেয়ে গতি পাচ্ছেন না, হোঁচড় খাচ্ছেন । ছড়াটিতে নেই কোন ছন্দ, ছন্দকাঠামো । এটাকে কী নিয়ম ভাঙ্গা বলবো ? উত্তরে পরে যাচ্ছি ।
তার আগে নিয়ম জানা প্রবীণ লেখক হাসনাত আমজাদের নিয়মভাঙ্গার ছড়া দেখে আসি ।
'ঢাকছে আকাশ কালো মেঘে
বইছে বাতাস উল্টোবেগে
ঝকঝকে ঐ রোদের আলো লাগছে কেমন ফিকে
ছুড়ছে কারা বর্শা বিষের বাংলা মায়ের দিকে ?
বলতে পারো, কারা ?
কেন এমন বিবেকবিহীন তারা ?
আকাশরে তুই মেঘে ঢাকিস না
সূর্যরে তুই চুপটি থাকিস না
আলোর ছটায় মেঘ কেটে যাক দূরে
দেখি কারা মায়ের গায়ে বর্শা মারে ছুড়ে ?
বাংলা মা তুই প্রিয়
ভালোবাসি, তাই বলি মা,যুগ যুগ যুগ জিও ।'
এই ছড়াটি পড়তে কেমন লেগেছে ? নিশ্চয়ই পড়তে যেয়ে গতি পাচ্ছেন, হোঁচড় খাচ্ছেন না । ছড়াটি স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা হলেও ছন্দকাঠামোকে ভাঙ্গা হয়েছে । আমরা স্বরবৃত্তছন্দের ছন্দকাঠামো জেনে এসেছি ৪+৪+৪+১ অথবা, ৪+৪+৪+২ অথবা, ৪+৪+৪+৩ এই নিয়মে । কিন্তু এই ছড়াটি এমন কোন প্রতিষ্ঠিত কাঠামো মেনে লেখা হয়নি । এটাই হচ্ছে নিয়ম মেনে নিয়ম ভাঙ্গা ।
নিয়ম ভাঙ্গার অধিকার তারই আছে যে নিয়ম জানে । নিয়মভাঙ্গা মানে নিয়মকে এভয়েড করা নয় । নিয়মকে বুকে ধারণ করে নিয়ম ভাঙ্গতে হয় ।
নিয়ম মেনে ছড়ালেখার মানে যুদ্ধ করা, নিয়ম ভেঙ্গে ছড়ালেখার মানে মহাযুদ্ধ করা । সুতরাং যুদ্ধে জয়ী হয়ে থাকলে মহাযুদ্ধে নামুন ।
ছড়ামর্শ- দশ।
-------------------
অনেকদিন পর ছড়ামর্শে ফিরলাম। আমরা চলতি পর্বগুলোতে জানবো শিশুতোষ ছড়া কী, সমসাময়িক ছড়া কী, রূপক ছড়া কী, কিশোর কবিতা কী, কবিতা কী, শিশুতোষ ছড়ার সাথে কিশোর কবিতার পার্থক্য কী, কিশোর কবিতার সাথে কবিতার পার্থক্য কী?
আজকের ছড়ামর্শটি শিশুতোষ ছড়া নিয়ে।
★ শিশুতোষ ছড়া কীঃ
শিশুদের জন্যে লেখা ছড়াকেই শিশুতোষ ছড়া বলে। এ ছড়া যে কোন বয়সী ছড়াকারই লিখতে পারেন। তবে তাকে শিশুমনস্ক ব্যক্তি হতে হবে। সেটা আবার কেমন? বলছি- শিশুর দিকে মন পড়ে থাকা। শিশুর সবকিছুতেই আনন্দ। 'কিছু জানি না' এরকম একটা ভাব। তাদের যাবতীয় পছন্দ-অপছন্দ, সুখ-দুঃখ ইত্যাদি বিষয়ে চিন্তা করার নামই শিশুমনস্কতা। আর যিনি এসব চিন্তা করেন তিনিই শিশুমনস্ক ব্যক্তি। সুতরাং আমরা বলতে পারি, শিশুমনস্ক ব্যক্তিরা শিশুদের জন্যে যেসব ছড়া লেখেন তাই শিশুতোষ ছড়া।
জাতিসংঘের সনদ অনুয়ায়ী শিশুর বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে সাত বছর। এক বছর বয়স থেকে সাত বছর বয়স পর্যন্ত শিশুকাল। শিশুকালের ভাবনা দিয়ে সেসব ছড়া রচনা করা হয় সেসব ছড়াই শিশুতোষ ছড়া।
কয়েকটি শিশুতোষ ছড়া দেখে আসি-
খোকাঃ
আচ্ছা মাগো টাকার মধ্যে এই ছবিটা কার?
কোন্ সিনেমার নায়ক তিনি? দেখতে চমৎকার!
মাঃ
ওরে বোকা চিনিস না তুই ছবির মানুষটাকে?
লেখক কবি শিল্পীরা তাঁর কত্তো ছবি আঁকে!
অভিনেতা নন তিনি নন, ছিলেন তিনি নেতা,
তাঁর কারণেই একাত্তরের যুদ্ধে হলো জেতা।
নায়ক তিনি ‘রাষ্ট্রনায়ক’ শোষিতদের মিতা,
তিনি হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু তিনি জাতির পিতা।
খোকাঃ
তাই নাকি মা? যোদ্ধা তিনি? করেছিলেন লড়াই?
তাঁকে নিয়ে তাই তোমাদের গৌরব আর বড়াই?
মাগো তোমার বঙ্গবন্ধু কোথায় থাকেন বলো,
সামনা সামনি দেখবো তাঁকে আমায় নিয়ে চলো।
মাঃ
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সকলখানেই থাকেন,
আদর করে বাংলাদেশকে বুকের মধ্যে রাখেন।
জন্মেছিলেন গোপালগঞ্জে, টুঙ্গিপাড়া গ্রামে,
নিত্য চিঠি লেখেন তিনি লাল সবুজের খামে।
খোকাঃ
আমিও চিঠি লিখবো তাঁকে কোথায় পাবো খাম?
ঠিকানাটা দাও লিখে দাও, দাও লিখে তাঁর নাম।
মাঃ
নাম হলো তাঁর শেখ মুজিবুর শুনতে লাগে বেশ,
শেখ মুজিবের নামের পাশে লিখবি ‘বাংলাদেশ’।
খোকাঃ
তাতেই চিঠি পৌঁছে যাবে জাতির পিতার কাছে?
মাঃ
পৃথিবীতে এমন ‘নায়ক’ আর কি কেউ আছে?
খোকাঃ
বাংলাদেশের নামের পাশে শেখ মুজিবের নাম,
লিখে রাখলাম মাগো আমি এই লিখে রাখলাম...।
(টাকার মধ্যে এই ছবিটা কার, লুৎফর রহমান রিটন)
শিশুমনে না জানা একটা ভাব থাকে। এই ছড়াটিতে সেই বিষয়টিই পরিলক্ষিত হয়।
আরেকটি শিশুতোষ ছড়া দেখি-
দাদুর মজা পানে
আপুর মজা গানে
মায়ের মজা বাবার সাথে
রাগ ও অভিমানে।
কাকুর মজা জিমে
বাবার মজা 'ঝিমে'
দাদার মজা সকালবেলা
কুসুম ছাড়া ডিমে।হ
মামার মজা ধারে
স্যারের মজা মারে
আমার মজা সুযোগ বুঝে
উইঠা পড়া ঘাড়ে।
(কত্ত মজা, পলাশ মাহবুব)
শিশুমন আনন্দে ভরা। এই ছড়াটিতে সেই বিষয়টিই পরিলক্ষিত হয়।
অন্য একটি শিশুতোষ ছড়া দেখে আসি-
ইরল বিরল চিরল পাতা,
খোকার ব্যাগে অনেক খাতা।
বিন্নিধানের মুড়কি খই,
আরো আছে দশটা বই।
কলাপাতায় গরম ভাত,
ব্যাগের ভারে খোকন কাৎ!
(ব্যাগের ভারে খোকন কাৎ, রেবেকা ইসলাম)
শিশুমনে যেমন আনন্দ থাকে তেমনি থাকে দুঃখ-কষ্টও। এই ছড়াটিতে তেমনই একটা কষ্ট ফুটে ওঠেছে।
মোরাল অফ দ্যা ছড়ামর্শ-
শিশুতোষ ছড়া লিখতে হলে অবশ্যই শিশুমনস্ক ব্যক্তি হতে হবে। শিশুদের যাবতীয় সকল বিষয়ে চিন্তা করতে হবে। এবং সেসব চিন্তা যথাযথভাবে ছড়াতে প্রয়োগ করতে হবে। তবেই শিশুতোষ ছড়া দাঁড় করানো সম্ভব।
ছড়ামর্শ- এগার।
----------------------
আজকের আলোচনার বিষয় 'রূপক ছড়া'।
★রূপক ছড়া কী?
রূপক ছড়া কী? এটা জানার আগে জেনে নিই রূপক শব্দটির মানে কী?
রূপ নির্মাণে চতুরতা বা বুদ্ধির আশ্রয় নিয়ে কোন বিষয় উপস্থাপন করাকে রুপক বলে। রুপকের ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই, মানুষ যখন চাক্ষুস বাস্তবের উপস্থাপন প্রকৃ্তিবাদ( Naturalism ) এর মধ্য দিয়ে করতে পারে না, তখন সে নানা ধরনের রহস্যবাদী সংকেত বা কৌশলের সাহায্য নেয় যা মূল গল্প বা ঘটনা থেকে সরে গিয়ে কোন পরোক্ষ অবলম্বনের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। আর এই সংকেত বা কৌশলকেই বলা হয় রূপক।
এবার খুব সহজেই রূপক ছড়া কী? তা সজ্ঞায়িত করা যায়। কোন একটি সংকট পরিস্থিতিতে ছড়াকারেরা যখন কোন ঘটনা বা বিষয়কে পাঠকের সামনে সরাসরি ব্যক্ত করতে পারে না, তখন তারা ছড়ার ভেতরে একধরনের সাংকেতিক কাহিনী তৈরি করে, যার লক্ষ্য হয় একটি বাস্তব ভাবের বহিঃপ্রকাশ। ছড়ার এই কৌশল বা মাধ্যমকেই বলা হয় রূপক ছড়া।
কয়েকটি রূপক ছড়া পড়ে আসি-
খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো
বর্গী এলো দেশে।
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেবো কিসে?
ধান ফুরুল, পান ফুরুল
খাজনার উপায় কী?
আর কটা দিন সবুর কর
রসুন বুনেছি।
জনপ্রিয় এই ছড়াটি একটি রূপক ছড়া। ছড়াতে বর্গী বলতে অষ্টাদশ শতাব্দীর লুটতরাজপ্রিয় অশ্বারোহী মারাঠা সৈন্যদলকে বুঝানো হয়েছে। ১৭৪১ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত দশ বছর ধরে বাংলার পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলিতে নিয়মিতভাবে লুটতরাজ চালাত বর্গিরা। বর্গিহানা এই সময় একপ্রকার বাৎসরিক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। বর্গি শব্দটি মারাঠি বারগির শব্দের অপভ্রংশ। বারগির বলতে মারাঠা সাম্রাজ্যের সেই সব অশ্বারোহীদের বোঝাত। এরা ছিল ধনগর জাতীয় এবং এদের ঘোড়া ও অস্ত্রশস্ত্র জোগান দিতেন সম্রাট। উল্লেখ্য, এই সাম্রাজ্যের শিলাদার বাহিনীকে সম্রাট ঘোড়া বা অস্ত্র জোগাতেন না, তারা নিজের রসদে যুদ্ধ করত। মারাঠি ধনগর জাতীয় লোকেরা অভিযানে যাওয়ার সময় কেবলমাত্র একটি সাত হাত লম্বা কম্বল ও বর্শা নিয়ে বের হত। এই বর্শাকে মারাঠি ভাষায় বলা হত বরচি। এই নাম থেকেই ধনগররা বারগির বা বর্গা ধনগর বা বর্গি নামে পরিচিত হয়। কিছু কিছু মারাঠা সেনাপতি যদিও সম্রাট আওরঙ্গজেব-এর অনুগত থাকলেও (ধরা যাক সমকালীন আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই-এর মতন) বেশির ভাগ মারাঠা সৈন্যই রোষবশত ভারতবর্ষে মুগল শাসিত প্রদেশগুলিতে লুঠপাঠ আরম্ভ করে। রোষের শিকার মুগল শাসিত প্রদেশগুলিতে সুবা বাংলা ছিল অন্যতম। বাংলা মুগলশাসিত প্রদেশ বলেই ১৭৪২ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত বার বার বাংলায় বর্গীদের আক্রমন সংঘটিত হতে থাকে। ১৭৪০ সালে আলিবর্দি খাঁ বাংলার নবাব হন। আলিবর্দি খাঁ যুদ্ধক্ষেত্রে প্রভূত বীরত্বের পরিচয় দিলেও বর্গি আক্রমণ ঠেকাতে সমর্থ হননি। ১৭৫১ সালের মে মাসে আলিবর্দি খাঁ মারাঠাদের সঙ্গে সন্ধিচুক্তি অনুযায়ী তিনি উড়িষ্যার অধিকার ছেড়ে দেন। এরপর বাংলায় বর্গি হানা বন্ধ হয়। তৎকালীন এই কাহিনী রূপকভাবে ছড়াটিতে প্রতিফলিত হয়েছে।
এইতো গেল তৎকালিক রূপক ছড়ার কথা। এবার আসি এই সময়ের কিছু রূপক ছড়ায়-
বিড়াল এখন ভেড়া সাজে, ছাগল সাজে বাঘ,
তাই না দেখে হরিণ মশাই করেন ভীষণ রাগ।
কাণ্ড এমন, গলা টেনে জিরাফ বলে হুম,
বনের যত পশুপাখি, নেই কারো আর ঘুম।
হাতির ছিল বিশাল দেহ, সেও কেমন মরা,
ক্যাঙ্গারুদের পায়ে দেখি সোনার নূপুর পরা।
ভল্লুকেরা গুহার ভেতর,বাইরে যেতে ভয়,
সন্দেহ ঠিক, রাজ্যে হঠাৎ কী যেন কী হয়!
বানরগুলোর লেজ বেড়েছে, লাফায় কয়েকগুণ,
পাতিশেয়াল গান ধরেছে হুক্কা হুয়া হুন।
সিংহমামা কেশর কেটে সাজলো দুধের গাই,
বনরাজ্যের কাউকে এখন চেনার উপায় নাই।
( বনরাজ্য, জুলফিকার শাহাদাৎ )
এই ছড়াটিতে রূপকভাবে আমাদের সমাজের দুর্দশার কথা ইঙ্গিত করা হয়েছে।
আরেকটি রূপক ছড়া দেখি-
একটা ছাগল খাচ্ছিল ঘাস বনের কিনার ঘেঁসে,
বনের এক শাহেন শাহ্ বাঘ দাঁড়ায় কাছে এসে।
মহা বেশে মিষ্টি হেসে নেড়ে ঘাড়ের চাদর,
বলল বাঘ চিকুন সুরে গলায় মেখে আদর-
'কীরে ছাগী কেমন আছিস? ছানার বয়স কত ?
হাম পলিওর ঔষুধ- টিকা দিয়েছিস ঠিকমত?
খাচ্ছিলে ঘাস পেট ভরে খা আমি এখন যাই,
আমি থাকতে বনে তোদের ভয়ের কারণ নাই।'
ছানার গায়ে হাত বুলিয়ে বাঘটা গেল চলে,
ছাগলছানা অবাক হয়ে ,দুচোখ মেলে বলে-
'ব্যাপার কী মা? হঠাৎ উনি মিষ্টি কথা বলেন,
সত্যি সত্যি তিনি তবে সুশীল হয়ে গেলেন!'
বুড়ো ছাগল বলল হেসে - ভেবে আপন মনে-
'মনে হচ্ছে নতুন করে ভোট এসেছে বনে।'
( ভোট, অদিত্য অনীক )
এই ছড়াটিতে রূপকভাবে ভোটকালীন নেতাদের অবস্থার কথা ইঙ্গিত করা হয়েছে।
অন্য একটি রূপক ছড়া দেখি-
বনের ভেতর পুকুরপাড়ে ঝোপের কোণে ঘর-
শুয়ে আছে হরিণ ছানা, মন ভালো নেই, জ্বর।
জ্বরের কারণ- 'মায়ের বারণ'। ছোট্ট মনে খুঁত,
হঠাৎ করে চাপলো মাথায় পড়াশোনার ভূত।
কে পড়াবে কে বা অনেস্ট? মায়ের মনে ডর,
কোথায় পাবে যোগ্য ভালো হাউজ টিউটর।
যেদিন 'শেয়াল, কুমির ছানার গল্প' প্রকাশ হয়,
সেদিন থেকেই চিন্তা বাড়ে, মনে চাপে ভয়।
তাই করেছে নিষেধ বারণ পড়াশোনা বাদ,
মন বোঝে না হরিণ ছানার জাগে আরো সাধ।
সাধ না মেটার অভিমানে যাচ্ছে বেড়ে জ্বর,
জ্বরের তাপে কাঁপছে শরীর কাঁপছে গলার স্বর।
এ অবস্থায় গাধা হাজির সাথে পাঠ্য বই,
আমি থাকতে নেই সমস্যা, ডাকো ছানা, কই?
কথা শোনে কী হলো ভাই মাথায় কেন হাত,
চোখে কেন বয়ে যাচ্ছে জলের ধারাপাত?
পড়াশোনায় চেঞ্জ এসেছে খোঁজ কি রাখো তার,
কে শেখাবে! গাধা ছাড়া নেই বিকল্প আর।
( গাধা ছাড়া নেই বিকল্প, জনি হোসেন কাব্য )
এই ছড়াটিতে রূপকভাবে আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার কথা ইঙ্গিত করা হয়েছে।
মোরাল অফ দ্য ছড়ামর্শ-
রূপক ছড়া লিখতে হলে অবশ্যই ছড়ার ভেতরে একধরনের সাংকেতিক কাহিনী তৈরি করতে হবে, যার লক্ষ্য হবে একটি বাস্তব ভাবের বহিঃপ্রকাশ। এবং সেটি চতুরতা বা বুদ্ধির সাথে যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে।