শুক্রবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৭

শেষ চিঠি

শেষ চিঠি
মুহম্মদ কবীর সরকার
_______________
কিছু কলমের কালি। একটা তুচ্ছ কাগজ। একের পর এক মনের মাধুর্য মিশিয়ে সাজানো কিছু হিজিবিজি শব্দ।আজ ও আমায় ভাবায়। শব্দের কি নিষ্ঠুর নীরবতা, কি আকুলতা! যেন একটি মানুষের ভালোবাসা, দুঃখ, বেদনা চুপটি করে বসে আছে চিঠি নামক ক্ষুদ্র কাগজে। নিভৃতচারী হয়ে ভ্রমণ করছে আমার হৃদয়ে।
আমি তখন কিশোরী। আমার এই ছোট্ট মনে দোলা দেয় এমনি একটি তুচ্ছ কাগজ। অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ছিলাম। বাবা ছিলেন সরকারি অফিসার। সেই সুবাদে আমরা চট্টগ্রাম থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বদলী হয়ে ছিলাম। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মফস্বল শহরে সেই রকম জানা শুনা আমার কেউ ছিল না। অন্নদা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে কারো সাথে সেই রকম ভাব জমছিল না। অচেনা শহর, অচেনা স্কুল, অচেনা পৃথিবী। তখন প্রায় একা হয়েই পড়েছিলাম। তবে পত্র-পত্রিকায় লেখালিখি করে ও বই পড়ে টুকটাক সময় যাচ্ছিলো। হ্যা তখন ও ফেবু, ইমু সবই ছিল। আমার ওই সবে সেই রকম আগ্রহ ছিল না বললেই চলে। সারাক্ষণ বই পড়ে সময় কাটাতেই ভালো লাগতো।
একদিন একটা মাসিক ম্যাগাজিনের পত্র মিতালী পাতায় একটুকরো অনুচ্ছেদ বন্ধুর খুঁজে লিখেছিলাম। সেই রকম ভাবে সাড়া পাইনি কারণ তখন সবাই চিঠিপত্তের সেকেলে নিয়ম বর্জন করে মেসেঞ্জার, ইমু,হোয়াটস্প নিয়েই ব্যস্ত ছিল। তবে কিছু সাহিত্য প্রেমি ছিল যারা এখনো চিঠি ভালোবাসে। সেই রকম কিছু বন্ধু আমায় অবাক করে চিঠি লিখেছিল। তার মধ্যে চিঠি লিখেছিলেন সেকেলের পত্রপত্রিকার চির পরিচিত মুখ সুদীপ্ত মেহেরাজ।
তখন আমার একাকীত্বে যেন মধুর স্বাদ পেয়েছিলাম। সুদীপ্ত মেহেরাজ চিঠিতে লিখেছেন।
প্রিয় মিমুণি,
তোর লেখা আমি সব সময় খুব মন দিয়ে পড়ি। তোর শিশুতোষ গল্প, কবিতা বরাবরি আমায় শিশু ভাবটা জাগিয়ে তোলে আমায় করে তোলে শিশু। তোর শিশু মনস্ক লিখা আমায় ভাবায়,হাসায়, কাদায়। আমার ভাবনায় চলে আসে যেন শিশু মীমটি আমার পাশে এসে ঘুরাঘুরি করছে।আমি নিয়মিত তোকে তোর লেখায় আবিষ্কার করতাম,তুই বলতি দাদা আমায় একটা কবিতা শুনাও না,বলতি চলো না দাদা ঘুড়ি উড়াই, ফড়িং ধরি।তখন আমি ঘুড়ি নিয়ে যেন মাঠে চলে যেতাম,আকাশে উড়িয়ে দেয় ঘুড়ি আর তুই হাত তালি দিতিস। আরো কত রকম বায়না। দিদি তুই কেমন আছিস? আমি অনেক দিন ধরে ভেবেছিলাম পত্রিকায় তোর ঠিকানাটা চাইবো কিন্তু চাও হয় নি। কাল যখন পত্র মিতালীতে তোর ঠিকানা পেলাম আর নিজে ধরে রাখতে পারলাম না। তাই তোকে ভেবে লিখতে বসলাম।
বন্ধু কি জানিস?
মনের কথা অকপটে বলা।
বন্ধু কি জানিস?
সুখে দুঃখে একই সাথে চলা।
বন্ধু কি জানিস?
ঝগড়া অভিমান আর রাগারাগি।
বন্ধু কি জানিস?
হৃদয়ের সবটুকু প্রেম ভাগাভাগি।
তুই কি সত্যিই বন্ধু হবি আমার।
ইতি
তোর চিঠির অপেক্ষারত
সুদীপ দা।
সেদিন চিঠি হাতে পেয়ে অনেক খুশি হয়েছিলাম। কতবার যে চিঠিটা পড়েছিলাম তা ঠিক ঠাহর করতে পারছি না। তারপর চিঠি লিখতে বসে ছিলাম। কি লিখবো কিছুই মাথায় আসছি না। লিখলাম..
প্রিয় সুদীপ দা
তুমি চিঠি দিবে আমি কখনো ভাবিনি। আমি তোমার নিয়মিত পাঠিকা।তোমার রোমান্টিক গল্প ও কবিতা গুলি আমার অনেক ভালো লাগে। তোমার বিরহের গল্প গুলি আমায় কাদায়। তোমার লেখায় এতো বিরহ কেন দাদা? আমাকে এতো কাদায় কেন? সে দিন তোমার 'শেষ কথা 'গল্পটি পড়ে প্রচুর কেঁদেছিলাম।গল্পের শেষ কথাটা কি হতে পারে জানো আজো ভেবে পাইনা। যেন গল্পটা আমার সাথে ঘটে গেছে। আমি গল্পে একটা বাস্তবিক গন্ধ পেয়েছিলাম। আমি জানতাম গল্পেরা মিথ্যা হয়, কিন্তু তোমার গল্প আমার কাছে সত্য মনে হল কেন দাদা? তুমি কেমন আছো দাদা? আমি তোমার এই ভাবে সব সময় বন্ধু হয়ে থাকতে চাই। শুনতে চাই তোমার সুখ দুঃখের গল্প।
ইতি
তোমার ছোট্টদি মীম।

এই ভাবে আমাদের বন্ধুত্বের তথা ভাইবোনের গল্পটা শুরু হয়েছিল। অতঃপর অধীর আগ্রহে সুদীপদার পরবর্তী চিঠির অপেক্ষা করতে লাগলাম।
চলমান....

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন