মঙ্গলবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৭

খুনি

থ্রিলার গল্প -খুনি
মুহম্মদ কবীর সরকার

জনমানব শূন্য দুর্গম পাহাড়ি পথে হেঁটে চলছে দুই ভাই। এক সময় তাদের একটা সুন্দর নাম ছিল। ছিল বেশ কিছু স্বপ্ন। বাবা ছিল, মা ছিল, বোন ছিল, ছিল একটা কুড়ে ঘর। সেখানে মাখামাখি করে বেঁচে থাকতো ভালোবাসারা। অনাহারে, শিক্ষাহীন, চিকিৎসাহীন ও এক বস্ত্রে দিনের পর দিন যেত, তবুও তাদের ভালোবাসার কমতি ছিল না। এখন তাদের সুন্দর কোনো নাম নেই।নেই কোনো ভালোবাসা। এখন তারা অজানা পথের পথিক। এখন তাদের পরিচয় ফেরারি আসামি!এখন তারা শুধুই খুনি!
দশবছরের এক শিশু তার ডান হাতের মাধ্যমাঙুল ধরে অজানা পথে হাটছে আরেকটি ৫ বছরের শিশু। তার বাম হাতে একটা লাশের মুণ্ডু(মাথা)। খানিক বাদে একফোটা করে রক্ত ঝরে পড়ছে সেই মুণ্ডু থেকে।যেন ঘন্টা খানেক আগে কারো দেহ থেকে আলাদা করা হয়েছে এই মুন্ডুটা। খানিক বাদে বাদে টপ টপ করে রক্ত ঝরে পড়ছে। তাজা রক্ত।

পরের দিন সারাদেশের প্রতিটি পত্রিকায় বড় বড় হেডলাইনে ছাপানো হয় "১০ বছরের ছেলে কাবীরের হাতে এক সেনাবাহিনী খুন" কাবীর, সেনাবাহিনীর মুণ্ডু ও তার ছোট ভাই ওমর(৫) নিখোঁজ। যে খুঁজে দিবে তাকে ১ লাখ টাকা পুরুষ্কৃত করা হবে। কেন খুন হয়েছে সেই সেনাবাহিনী তা কেউ জানে না, এমনকি কেউ জানতে ও চায় নি! এখন জনগণ, মিডিয়ার কাজ শুধুই দুটো ছেলেকে খুঁজে বের করা। সাথে ওই মুণ্ডুটা। কারো কোনো জানার আগ্রহ নেই, কেনো দুটো অবুঝ শিশু খুনি? যাদের খেলার কথা ছিল চোর পুলিশ। কেন তারা খুনি? কে তাদের মানসিক বিকাশের ব্যাঘাত ঘটিয়েছে? তারা আজ বিকৃত মস্তিষ্কের দুটো নাবালক শিশু। আজ তাদের হাতে কাটা মুণ্ডু নিয়ে ঘুরার সুযোগ করে দিয়েছে এই পরিবেশ, এই দেশ।

ওমর বললো, 'ভাই আমার পানি তৃষ্ণা পেয়েছে আর কত হাঁটবো! " এই তো আরেকটু হাঁটলেই আমরা গন্তব্যে পৌছে যাবো।
-পানি তৃষ্ণা পেয়ে তো!
-পানি পান করবি?
- হ্যাঁ।
পানি কোথায় পাই। আশেপাশে তো জঙ্গল ছাড়া আর কিছুই নেই। রক্ত পান করতে পারবি?
-রক্ত পান করা যায় নাকি?
- তাছাড়া এটা মানুষের কল্লা!
সে আমাদের রক্ত পান করেছে, আমাদের সুখ খেয়েছে, ভালোবাসা খেয়েছে, আমাদের স্বপ্নগুলি খেয়েছে। আর তুই এই অমানুষের রক্ত পান করতে পারবিনা?
- ওমর(৫) বললো, ভাই তুই যা বলবি তাই করতে আমি প্রস্তুত। ওটা শুধু অমানুষের রক্ত তো দে পান করে নিচ্ছি।
অতঃপর ওমর সেনার মুণ্ডুর রক্ত দিয়ে তৃষ্ণা মিটালো।

অজানা পথে হেঁটে চলছে এই দুটো শিশু। তারা শুধুই জানে তাদের গন্তব্য জঙ্গলের পর নদীর ওই পাড়ে। যেখানে এই দেশের আইন চলে না। যেখানে অচল এই দেশের শাসন । রক্ত শূন্য মুণ্ডু হাতে হেঁটে চলছে। অতঃপর আরেকটি রাত। নির্জন ভয়ঙ্কর জঙ্গল। চুপটি করে একটি গাছ তলায় আশ্রয় নিল তারা। অনাহারে ও ক্লান্ত হয়ে ভাইয়ের বুকে ঘুমিয়ে গেছে ছোট্ট ছেলেটি। যার কাছে পৃথিবী অধরা। হ্যাঁ সে পৃথিবীকে দেখেছে, পৃথিবীকে দেখেছে নিষ্ঠুর, নির্মম। আজ এই ভয়ঙ্কর রাতে তাদের কোনো ভয় নেই। কেননা এর চেয়ে ও কঠিন রাত তাদের ভয় গুলিকে চোরে করে নিয়েছে। চুরি করে নিয়েছে তাদের শিশুত্বকে। আজ তারা শিশু নয়। আজ তারা পাঁচ ও দশ বছরের যুবক । পৃথিবী তাদের সুন্দর মস্তিষ্কে জন্ম দেয়নি, আজ তারা পৃথিবীকে আবার নতুন করে জন্ম দিবে।

ছোট্ট ছেলেটি ভাইয়ের বুকে ঘুমিয়ে মায়ের বুকের সাধ নিচ্ছে।

মা-বাবা, বড় বোন ও এই দুই ভাই মিলেই তাদের পরিবার ছিল। ভোরে মায়ের কুরান তিলাওয়াতে ঘুম ভাঙ্গতো। শিশিরে স্নান করা নগ্ন পায়ে ছোটে যেত তিন ভাই বোন পাড়ার মক্তবে। মক্তব শেষ করলেই সারা দিন তাদের খেলাধুলা, ঝগড়া আর মায়ের বকনি। কেননা তাদের স্কুলে পড়া নিষেধ ছিল। তাই তারা স্কুলে যেতে চাইলে ও পারেনি। এটা সরকারের আদেশ। তাদের সকল সম্পত্তি এখন জ্ঞানি ধার্মিকদের দখলে। এটাও সরকারের আদেশ।বাবা সারাদিন নিজের ক্ষেতে অন্যের গোলামি করতে হতো। বেলা শেষে অর্ধেক মজুরি নিয়ে বা না নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হতো।এটা ও সরকারের আদেশ। সারাদিন কাজ করে নিজের ক্ষেতে, দুই মুঠো খাবার ও জুটতো না।নিজের সকল ফসল তুলতে হত তথাকথিত জ্ঞানী ধার্মিকদের কুঠুরিতে। তাদের বুকের ওপর বসে জ্ঞানী ধার্মিক ও সরকার চুষে খেতো তাদের তাজা রক্ত। অতঃপর ফেলে দিত কঙ্কালসার। সারাদিনের মজুরী নিয়ে রাতে যেতো বাজারে। দোকানীরা তাদের কাছে পণ্য বিক্রি করতো চড়া দামে। এই ভাবেই তারা বেঁচে ছিল যদি তাকে বেঁচে থাকা বলে।তাদের নিষিদ্ধ করা হল মাছ ধরা, কৃষিকাজ এমন কি নাগরিকত্ব ইত্যাদি থেকে।তারা জানতো না কেন তাদের ওপর এত আগ্রাসন। পৃথিবীর কোনো ধর্ম কি এসব শিক্ষা দেয়? ধর্ম তো মানুষকে সভ্য বানাই, পাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। তাহলে তারা( তথাকথিত জ্ঞানী ধার্মিক) কি নিজের ধর্ম পালনে ব্যর্থ?
সব কিছু ছিনিয়ে নিয়ে ও তারা(সরকার) ক্ষান্ত হয়নি। তাদের বাঁচতে দিল না। এক রাত্রে সেনাবাহিনী ও তথাকথিত জ্ঞানী ধার্মিকরা এসে হুমকি দিয়ে গেল" তোরা এই দেশ থেকে চলে যা ও এই দেশ তোদের নই। তোদের দেশ বাংলাদেশ।" ১৫ শতাব্দী থেকে বাস করে আসছে তারা।আজ বলছে এটা তাদের দেশ নই। কিন্তু তারা বাপদাদার ভিটামাটি থেকে যায়নি।

তারপর সেনা ও তথাকথিত জ্ঞানী ধার্মিক লোকেরা চালাই তাদের নিঃসংশয় অপকর্ম ও তাণ্ডব।
সেই রাতে এই বাচ্চাদের জীবনে ঘটে গিয়েছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনা। বিকট শব্দ করে একদল ইউনিফর্ম পড়া সেনা বলপূর্বক প্রবেশ করলো তাদের ঘরে। তাদের বাবা বাধা দেওয়া তাকে গুলি খেয়ে মরতে হয়। তাদের মা ও বোনের ওপর নির্যাতন চালাই। তাদের এমন কিছুও দেখতে হল যা কখনো দেখবে তারা ভাবিনি। এই দেশ তাদের দেখিয়েছে। আচ্ছা দেশ নাকি মায়ের মত তাহলে দেশ কেন তার সন্তানের এত অবহেলা করে। দুটো ছেলে ধরে তাদের সামনে বিবস্ত্র করা হয় তাদের মা বোনকে। নির্মম ভাবে অত্যাচার করা হয়। এই কষ্ট সহ্য না করতে পেরে মারা গিয়েছিল তাদের দিদি। আধমরা হয়ে পরে ছিল গর্ভধারিণী মায়ের বস্ত্রহীন নিথর দেহ। একেরপর এক তাদের অত্যাচার চালাচ্ছিল। সবাই যখন চলে যাই তখন একজন সেনা ছিল সুযোগ বুঝে ওই সেনার দেহ থেকে মাথা আলাদা করে দেয় বাচ্চারা।
-চলমান

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন