
"কত লক্ষ জনম ঘুরে ঘুরে আমরা পেয়েছি ভাই মানব জনম। এ জনম চলে গেলে আর পাবো না। না না না আর মিলবে না। তারে হৃদ মাঝারে রাখবো ছেড়ে দেবো না।
এই গানটি আমাদের সকলের কমবেশ জানা আছে। গানের কথা, সুর ও কন্ঠ দিয়েছিলেন ফকির লালন শাই। যিনি শুধুই মানুষ ও মনুষ্যত্বের গান গেয়েছিলেন। সেই মানব জীবন আমরা আজ কতটুকু ধরে রাখতে পারলাম? আদৌও পারবো কি যেটুকু আছে সেটাই ধরে রাখতে? কিছু সংখ্যক বিজ্ঞানী বলে গেছেন মানুষ নাকি অন্য প্রাণী থেকে বিবর্তিত। যদিও ধর্ম গ্রন্থ বলে থাকে অন্য কথা। যদি মানব জাতি অন্য প্রাণী থেকে বিবর্তিত না হয়েও থাকে, তবে এটা নিশ্চিত যে আসছে আগামী প্রজন্ম মানুষ থেকে অন্য প্রাণীতে বিবর্তিত না হোক, এক একটি যান্ত্রিক মানুষে রূপান্তরিত হবে যে তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের পূর্বপুরুষের কথায়ই বলি, তারা ছিল খুবই শক্তিশালী। তাদের নিবাস ছিল গুহা।পুরুষেরা করতো পশু শিকার আর নারীরা জন্ম দিয়েছিল কৃষি কাজ । তারা খাবারের তাগিদে ফসল ফলাতো। লজ্জাস্থান ডাকতো গাছের ছাল বা পাতা দিয়ে, ধীরেধীরে শিখলো কাপড় বানানো । শিখলো ঘর বানানো। ছেড়ে দিলো জঙ্গল, হয়ে উঠলো সভ্য। মনের ভাব প্রকাশ করতে তৈরী হল সাংস্কৃতিক ভাষা, তারপর অর্থবোধক ভাষা। তারপর লিখিত রূপ। মানুষে মানুষে তৈরী হল গভীর বন্ধন। সৃষ্টি হল সাহিত্য নামক অপার এক পৃথিবী যা পৃথিবীর অন্য কোনো পশু প্রাণীর মধ্যে পাওয়া যায় না। সব কিছু বিজ্ঞানেরই ফসল। আমাকে আপনাকে সবাইকে এইটুকু সত্য মানতেই হবে। কিন্তু বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, 'অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ ' বিজ্ঞান সেই আদিকাল থেকে মানুষের মস্তিষ্কে চেপে বসেছে। এখনো ঘাড় থেকে নামিনি। বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ আর কেড়ে নিয়েছে আবেগ। আমাদের মানব জাতিতে বিজ্ঞান এমন ভাবে ভর করেছে তা ভাবাও যায় না। বিজ্ঞানের ব্যবহার চলছে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে। শিক্ষাক্ষেত্রে বিজ্ঞান ইতিবাচক ও নেতিবাচক মিলিয়েই দখল করে রয়েছে। একজন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র তার আছে ল্যাপটপ নামক যন্ত্র। যেখানে আছে লেখাপড়ার বিপুল ভাণ্ডার।আছে হাজার খানেক পিডিএফ কপি। আছে হাজার খানেক গেইমস। আর আছে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম। সারাদিন গেইমস নয়তো সামাজিক মাধ্যমে ভারচুয়াল যোগাযোগ রক্ষা চলছে তার নিত্যদিনের সঙ্গি। তাছারা এর বাহিরে আর কাজ থাকলে তো যাবে! তাদের ভোর হয় আটটা কি নয়টাই! আপনার প্রশ্ন জাগতে পারে তাহলে তারা কি ভোরের হাওয়া, পাখির কিচিরমিচির ও সূর্য উদয় উপভোগ করেনি কখনো? আরো একটু বাড়িয়ে বলবেন যে, প্রত্যুষ না দেখলে আমার দিনটাই মাটি! হ্যা তারা প্রতিদিনি ভোর দেখে, দেখে পাখির কিচিরমিচির, ভোরের রবিরশ্মি উপভোগ করে। তাদের সেই যন্ত্রের নাম হচ্ছে ভারচুয়াল রিয়েলিটি।
আপনার আশেপাশে কয়েক ডজন স্কুল পেয়ে যাবেন। কখনো একটা জিনিস কি লক্ষ্য করেছেন সেই স্কুলে খেলার মাঠ আছে কিনা? লক্ষ্য করেন নি। স্কুল- কলেজে যদি খেলার মাঠ না থাকে তাকে স্কুল বলা যেতে পারে আমি ভাবতেও পারিনা। কেননা একজন ছাত্র বড় হবে খেলাধুলো করে। সে তার বাসায়ও খেলার সুযোগ পাচ্ছে না স্কুলেও পাচ্ছে না। তাহলে সে পেলটা কী? তারপর সেই শিশু বাধ্য হয়েই ভারচুয়াল জগতে ঝুকে পড়বে। তখন সে ভারচুয়াল আর বাস্তবে তফাৎ করতে পারবে না। তখন সে তার আশেপাশের মানুষকে ভিন্ন চোখে দেখবে এটাই স্বাভাবিক। তার সাথে আশেপাশের লোক জনের আচরণ আর আশেপাশের লোকজনের কাছে তার আচরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবেই, তাতে দোষের দেখছিনা। লোপ পাবে তার ব্যক্তিত্ব বোধ! কারণ সে তো সারাক্ষণ টেবিলের ল্যাপটপের নিকটে বসা ছিল। সে মিশেনি কোনো বন্ধুদের সাথে, হ্যা সে মিশেছে ভারচুয়াল বন্ধুর সাথে। তাহলে আপনার কি মনে হয় না আমরা যান্ত্রিক মানুষ অর্থাৎ তথাকথিত রোবট হয়ে যাচ্ছি।
তারপর দেখুন এক সময় মানুষ জন্মাতো প্রাকৃতিক ভাবে। তারপর মানুষ জন্মাচ্ছে পেট কেটে, তারপর মানুষ জন্ম দিচ্ছে টেস্টটিউবে। যা কিনা একটা দম্পতী বা অন্য কোনো আত্মীয় হতে পারে বা সম্পর্ক নাও থাকতে পারে সেই মহিলার ডিম্বাণু ও পুরুষের শুক্রাণু বিজ্ঞানাগারে একত্র করে তৈরী করছে মানব সন্তান। সব কিছুও সুখের জন্য। হ্যা বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে অনাবিল সুখ। কিন্তু আপনার মনে এই প্রশ্ন জাগেনি যে, বিজ্ঞান আমাদের থেকে কিছুই কি কেড়ে নিচ্ছে না? নিচ্ছে, তাহলে সেটা কি? মানব জীবন! মানুষ জীবন তো এমন হওয়ার কথা ছিল না। বিজ্ঞান মানুষ জীবনকে কেড়ে নিয়ে দিচ্ছি রোবট জীবন, দিচ্ছে যান্ত্রিক জীবন। কেননা মানব জীবন তো এমন হওয়ার কথা ছিল না। এখন বিজ্ঞানের লক্ষ্য শুধুই মস্তিষ্ককে শান্ত রাখা, মানে মস্তিষ্কের ক্ষুধা মিটানো। মস্তিষ্ক যদি শান্ত থাকে তাহলে আর কিছুই প্রয়োজন পড়ে না মানুষের। কেননা এই প্রসঙ্গে হিপোক্রেটাস বলেছেন "ব্রেইন থেকে, এবং শুধুমাত্র ব্রেইন থেকে-ই,উৎপত্তি আমাদের আনন্দ,উল্লাস,হাসি এবং কৌতুক, যেমন উৎপত্তি আমাদের দুঃখ,ব্যাথা-বেদনা, মনস্তাপ, অনুশোচনা এবং কান্না..." এখন ভাবুন যদি আমরা কৃত্রিমভাবে ব্রেইনকে খুশি রাখতে পারি তাহলে কিন্তু বাস্তবে আর করতে হবে না। আমাদের লাগবে না হাত কিছু ধরে অনুভব করার জন্য অর্থাৎ ফুল ধরে ফুলকে অনুভব করার প্রয়োজন নেই।, লাগবে না পা, হাঁটার জন্য। লাগবে না চোখ, দেখার জন্য। আমরা না খেয়েও মস্তিষ্ককে বুঝাতে পারবো খেয়েছি। আমরা জানি, কোনো কিছু দেখতে হলে চোখ প্রয়োজন। প্রথমেই বস্তুটির আলো চোখে পড়বে তারপর চোখ মস্তিষ্কে সিগনাল পাঠাবে তারপর মস্তিষ্ক বুঝবে যে এটা লাল রঙ অথবা কালো। সেই ভাবে হাত পা সবই মস্তিষ্কের কাছে সিগনাল পাঠায়। এখন মোদ্দা কথা হচ্ছে আমরা যদি সিগনালের অপেক্ষা না করে সরাসরি মস্তিষ্ক বুঝে নেই তাহলে আর হাত পা চোখ নাক কান কিছুরই প্রয়োজন পড়ে না আমাদের। ফুলের যেমন দরকার নেই গন্ধের জন্য, খাবারও দরকার নেই ক্ষুধার্ত পেটের জন্য। যদি দরকারও পড়ে আমাদের আছে আমাদের বানানো লোহ দিয়ে লোহ মানব। সে চাষাবাদ করে নিয়ে আসবে! তাহলে আমরা কি পেলাম? পেলাম পরিশ্রম ছাড়াই দেখার অনুভূতি, শুনার অনুভূতি। আমরা পেলাম সুখ। তাহলে আমরা মানব জীবন কি টিকিয়ে রাখতে পারলাম, নাকি বিবর্তিত হলাম যান্ত্রিক মানুষে? তাছাড়া বিশ্বের বেশ কিছু পরমাণু ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের তহবিলে মজুত আছে অনেক পরমাণু বোমা যা একটা দেশ, একটা জাতি ও একটা পৃথিবীকে ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে। আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা জানি, ১৯৪৫ সালের ৬ই আগস্ট সকালে
যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী
জাপানের হিরোশিমা শহরের ওপর
লিটল বয় নামের নিউক্লীয় বোমা ফেলে এবং এর তিন দিন পর
নাগাসাকি শহরের ওপর ফ্যাট ম্যান নামের আরেকটি নিউক্লীয় বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।হিরোশিমাতে প্রায় ১৪০,০০০ লোক মারা যান। নাগাসাকিতে প্রায় ৭৪,০০০ লোক মারা যান এবং পরবর্তীতে এই দুই শহরে বোমার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান আরও ২১৪,০০০ জন। এখনো লেগে আছে ওই দুটি শহরে সেই বোমার কলঙ্কের চিহ্ন! পৃথিবীর কাছে কি দোষ করেছিল ভাবি প্রজন্ম। আজ তারা জন্ম হচ্ছে বিকলাঙ্গ হয়ে। তাহলে বিজ্ঞানকে আমরা ভরসা ও বিশ্বাস করে সেই অন্ধকার যুগ থেকে আধুনিক যুগ নামক ধ্বংস স্তবে নিয়ে এসেছি নয়কি? যে কোনো সময় মানুষ নামক রোবটের ভুলে ধ্বংস হবে মানব সভ্যতা, ধ্বংস হবে পৃথিবী।

কয়েক বছর আগে আমার এক ঢাকাইয়া কাজিন বেড়াতে এসেছিল আমাদের গ্রামের বাড়িতে। সে তো এসে রীতিমত কাহিল হয়ে গেছে। আমাকে বলেছিল তোরা বড়ই উদ্ভূত! এই ভাবে মানুষ বেঁচে থাকে কি ভাবেরে? আমি বলেছিলাম, মানুষ কি ভাবে বাঁচতে পারে আমার বোধহয় জানা নেই, আর তাও জানা নেই কোনটাকে বাঁচা বলে! সে বেশিদিন টিকতে পারেনি আমাদের গ্রামে। বড়জোর দুদিন রেখেছিলাম। যাবার সময় একটা চিরকুটে লিখে দিয়েছিলাম। চিরকুটে ছিল এই কয়েকটা লাইন
তুমি একটা শহুরে রোবট
আমি গ্রামের ভূত!
তোমার শহরটা বড়ই উদ্ভট
আমিও বেশ উদ্ভুত!
লেখক: কবি ও সাহিত্যিক।
পদার্থবিদ , ইকরা স্কুল এন্ড কলেজ। মো.নগর, বায়েজিদ, চট্টগ্রাম।
লেখকের ইমেইল : MahdiKaabir@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন