শনিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

বিষণ্ণ ঈশ্বর

-মাহ্দী কবীর


স্মৃতির কথা বলতেই প্রফেসর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো, আসলেই স্মৃতিতে জমে আছে কত শত গল্প, হৃদয়ের কোনো এক কোণে ধূসর-সোনালি ধূলিকণায় মুড়িয়ে থাকে তারা। বেলাশেষে চায়ের কাপে চোখ বুঝলেই চোখ জুড়িয়ে আসে কিংবা হাত পুড়িয়ে আসে কিছু স্মৃতি। স্মৃতির সম্মোহন গুলি অনেক সুন্দর হয়। মন তাকে ধরে রাখতে চাই, এই সম্মোহন যেন শেষ না হয়। অথচ সম্মোহনের পদস্খলনে আবিষ্কার করি আমি সেই ষাট বছরের বৃদ্ধ'কে ।সময়ের দৌড়ে আজ আমরা ক্লান্ত। প্রকৃতপক্ষে মানুষ কি বৃদ্ধ হয়?

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মফস্বল শহরে জন্ম হয় আমার।সেই সুবাদে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শৈশব কাটে। স্কুলের প্রথমদিনটি ছিল খুব মজার। বাবা আমাকে একটা সাদা শার্ট দিয়ে বলেছিল, 'এটা তোমার স্কুল ড্রেস।' আমি বলেছিলাম,' বাবা সাদা ড্রেস কেন? এখুনিতো ময়লা হয়ে যাবে!'
"সে জন্যই সাদা শার্ট, যেন ময়লা হলেই দেখা যায় এবং তা পরিষ্কার করতে হয়। যেন সাদা শার্টের মতোই তোমার মনও সর্বদা পরিষ্কার থাকে।" সে দিন থেকে সাদা শার্টটি আমার প্রিয় হয়ে উঠলো। কিন্তু সাদা শার্টের আরো যে রহস্য ছিল তা কে জানতো! কে জানতো এই সাদা শার্টের ভার আমার জন্য অসহনীয় হয়ে যাবে। এই ভার বহন করতে হবে অন্তিমকাল পর্যন্ত কে জানে! বাবাও আমাকে বলেনি। আমি স্কুলে গিয়ে আরো বুঝতে পেরেছিলাম সাদা শার্ট কেন অন্যান্য শার্টের মতো নয়। এই শার্ট যেন কোনো বাঁধুনিতে বেধে রাখে আমায়। সেই বাঁধুনি কি কোনো এক দায়িত্ব বা কর্তব্যের? হ্যা সেই শার্ট আমাকে করে শাসন, করে বারণ, আমাকে শিখাই নীতি নৈতিকতা। শিখাই ভালোবাসতে। এই শার্ট পড়ে ইচ্ছে করলেই আমি মিথ্যে বলতে পারিনা অর্থাৎ এই শার্টে আমি সর্বপুরি কিছুতে বাধা পড়া যাই, আমি থাকিনা সেই দূরান্ত পনা দস্যি ছেলে। তবুও কিভাবে যেন এই ইউনিফর্ম আমার মনে জায়গা করে বসলো কিছুতে ঠাহর করতে পারিনি। তাকেই বুঝি ছাত্র বলে। তাই আজও, এই বয়সেও খারাপ কাজ করতে ভয় পাই, যখন দেখি আমার গায়ে 'সাদা শার্ট' । তাহলে কি এখনো আমি ছাত্র? কতটুকু সম্মানের জায়গায় আছে এই শার্ট তা এক মাত্র ঈশ্বর জানেন। আসলে কিছুকিছু পরাধীনতা অনেক মধুর হয়। যেমন মায়ের হাতের শাসন, তা কি কখনো ভুলা যায়? অথবা ধরো ঘুড়ি। লাল ঘুড়ি , নীল ঘুড়ি , সাদা ঘুড়ি, কত রকম ঘুড়ি আকাশে উড়ে! তারাও কিন্তু পরাধীনতার সেই মধুর সাধ গ্রহণ করে। সুতোই ঘেরা তার অমিয় পরাধীনতা। যদিও কখনো কোনো ঘুড়ি স্বাধীন হতে চাই, সুতো ছিঁড়ে সেই আর বেশিক্ষণ উড়তে পারে না? মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে সেই দুর্ভাগা সুতো ছেঁড়া ঘুড়ি । তাই সাদা শার্টের পরাধীনতা আমি ভালোবাসি। মায়ের শাসন, বাবার আদর কখনোই পরাধীনতা হতে পারে না। ঠিক সেই ভাবে সাদা শার্টও তোমায় শিকল পড়াইনা বরং মানুষ বানাই। এখন প্রায়ই একাকীত্ব বোধ করি। যখন মা- বাবা ও নানু ছিলেন ভুল করতে খুব মজা পেতাম। কারণ জানতাম মা এসে চোখ রাঙ্গিয়ে বলবে 'কবীর তুমি এটা ঠিক করোনি।' কিন্তু এখন সেই চোখ রাঙ্গানোর কেউ নেই। চায়ের কাপে আমার জীবন থমকে গেছে। চায়ের কাপে এক ঠোট চুম্বন যেন এক যুগ পিছিয়ে দেয় আমায়। পিছিয়ে যাই আমি অনেক পিছিয়ে, সময়কে প্রসঙ্গ কাঠামো রেখে। সময় কি প্রসঙ্গ কাঠামো অর্থাৎ স্থির থাকার পাত্র? না, তাই সেও চলছে স্মৃতিপট মাড়িয়ে। এখন শ্বাসপ্রশ্বাসের স্থায়িত্বকালটা বড্ড বেশিই বেমানান, বড্ড বেশিই বেড়ে গেছে।

প্রফেসরের কথা থামিয়ে করে ওয়েটার বলে উঠলো
স্যার, রঙ চা'য়ে কি চিনি কম হবে? প্রফেসর মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন 'হবে'। এতক্ষণ আমি চুপ করে স্যারের কথা শুনছিলাম। এখন কথা বলার সুযোগ পেয়ে হাত ছাড়া করেনি।বললাম স্যার আপনার প্রিয় মানুষ সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?

আমার প্রথম শিক্ষক আমার নানু।নানু কয়েক পাতা আরবি ছাড়া আর কিছুই জানতো না, অথচ তাঁর কাছেই আমার বাংলা, অংক ও ইংরেজির হাতেখড়ি। মজার কথা হলো তিনি(নানু) আমাকে পড়াতে পড়াতেই অনেক কিছু শিখে ফেলেছিল।সেই মুখটি আমার অনেক প্রিয়। যদিও আমার জীবনের সবচেয়ে বেশি বুকনি খেতে হয়েছে এই মুখটি থেকে।
অসমাপ্ত

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন